‘বোহেমিয়ান ঘোড়া’ দিয়ে দর্শকের সকল প্রশংসা নিজের ঝুলিতে নেন অভিনেতা রাকিব হোসেন ইভন। সেই রেশ না কাটতেই ধরা দেন ‘তাণ্ডবে’। শাকিব খানের সিনেমায় আলাদাভাবে নজর কাড়া কঠিন হলেও ইভন কঠিনেরে সহজ করেছেন। পেয়েছেন বাহবা। সম্প্রতি ঢাকা মেইলের সঙ্গে কথোপকথন জমেছিল তরুণ এ অভিনেতার।
‘বোহেমিয়ান ঘোড়া’ ও ‘তাণ্ডবে’ অভিনয় করে প্রশংসা পাচ্ছেন। এটা প্রত্যাশা করেছিলেন?
বিজ্ঞাপন
ভালোবাসা থেকে কাজ করি। যখন করি ভালোভাবে করার চেষ্টা করি। পরিচালক যেভাবে চান গল্পের চরিত্রকে সেভাবে বাস্তবায়নের চেষ্টা করি। সেই জায়গা থেকে তখন এসব মাথায় ছিল না। এখন দর্শক দেখছেন এবং পছন্দ করছেন। এটা নিঃসন্দেহে আনন্দের। এতটা প্রত্যাশা করিনি।

মোশাররফ করিমের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?
মোশাররফ ভাইয়ের সাথে এটা প্রথম কাজ। এর আগে তার সঙ্গে কখনও দেখাও হয়নি। ৩ আগস্ট ফার্মগেটে আন্দোলন করার সময় ওনাকে দূর থেকে দেখছিলাম। স্বপ্ন ছিল ওনার সঙ্গে কাজ করার। হুট করে এই কাজটা (‘বোহেমিয়ান ঘোড়া’) করে ফেলি। উনি এত কমফর্টেবল যে কাজের পর মনে হয়েছে আমার জীবনে যদি কোনো শ্রেষ্ঠ কো-আর্টিস্ট থাকেন তিনি মোশাররফ ভাই। তিনি মানুষ হিসেবেও সেরা। আমাকে যে সম্মান ও সুযোগ দিয়েছেন বলে শেষ করা সম্ভব না। উনি আমার অর্ধেক ক্যারেক্টার পাশে দাঁড়িয়ে থেকেই করে দিয়েছেন।
মোশাররফ করিমের সঙ্গে কাজ করবেন শুনে কেমন লাগছিল?
বিজ্ঞাপন
মোশাররফ ভাইয়ের সাথে কাজ করব শুনে অধীর আগ্রহে ছিলাম। শুরুতে কথা হয়নি। স্ক্রিপ্ট পড়ার সময় আমি আমার কাউন্টার দিয়েছি। উনি ওনারটা দিয়েছেন। নিজেদের মধ্যে তখনও কথা হয়নি৷ শুটিংয়ে যাওয়ার সময় মনে হলো কথা না বললে ব্যাপারটা বেয়াদবি দেখায়। সালাম দিয়ে বললাম, ভাইয়া, আমার নাম রাকিব হোসেন ইভন। আপনার সাথে চরিত্রটা করার চেষ্টা করব। ভাই তখন আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে কাঁধে হাত রেখে বললেন, চলো আমরা মজা করতে করতে কাজটা করে ফেলি। তখন আমার মনে হয়েছে, আচ্ছা ঠিক আছে আমি অন্তত শুটিং পর্যন্ত নির্ভার। শুধু মোশাররফ করিম না। ‘বোহেমিয়ান ঘোড়া’র ক্ষেত্রে আমার জন্য তিনটা বড় ফ্যাক্টর কাজ করছে। অমিতাভ রেজা চৌধুরী, মোশাররফ করিম ও সিনেমাটোগ্রাফার খসরু ভাই। অমিতাভ রেজার সাথে এর আগে একটা টিভিসি করেছিলাম। এটাই প্রথম বড় ফিকশন। খসরু ভাইয়ের নাম শুনে বড় হয়েছি। কিন্তু জীবনে চোখে দেখিনি। এই তিনজনের সাথে কাজ করব ভেবেই এতো প্রেশার লাগছিল যে নিতে পারছিলাম না। একটা সময় মনে হয়েছে আমার দায়িত্ব হচ্ছে কাজটা করা। যা বলা হবে নিজের মতো করে করব। ভালো না লাগলে ডিরেক্টর বলবেন। পুরো সিরিজটা আড্ডা দিতে দিতে শেষ করেছি। নিঃসন্দেহে ভয় ছিল। তবে ভয়টা ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়েছে।

ট্রাক ডাইভার আব্বাস তার স্ত্রীদের সঙ্গে যত না সময় কাটায় সেলিমের সঙ্গে তার চেয়ে বেশি সময় কাটায়। পর্দার পেছনে সে রসায়ন কেমন ছিল?
প্রথম দিন শুটিং করলাম। সবাই বললেন সবকিছু ঠিকঠাক। কিন্তু রাতের বেলায় দ্বিধায় পড়ে গেলাম। অজব কথা, কেউ কিছু বলছে না! এত ভালোও অভিনয় করার কথা না। তারা কি এমনিতেই প্রশংসা করছেন! পরদিন যখন শুটিং সেটে গিয়ে নাস্তা করছিলাম অমিতাভ ভাই এসে জড়িয়ে ধরে বললেন, সেলিম খুব সুন্দর। যেটা করছিস এটাই ধরে রাখ। অমিতাভ ভাই বলেছেন মানে চাপ নেই। এরপর ট্রাকের মধ্যে সিন করছিলাম। তখন মোশাররফ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কি কোনো দল (থিয়েটার) করো? বললাম জ্বি ভাই। ভাই বললেন, কোন দল। আমি বললাম। এরপর নিচে নেমে চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম। ভাই সামনের চেয়ারে আমি পেছনের চেয়ারে। তখন আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে হুট করে বললেন, যে চেষ্টা আছে সেটা ধরে রাখিস। আর একটা জিনিস সব সময় মাথায় রাখবি আর্টিস্টের জীবনে সবচেয়ে বড় হচ্ছে তার সততা। এই কথাটা শোনার পর মনে হলো, আমি কেঁপে উঠছি। এটা অনেক বড় অর্জন এবং একইসাথে উপদেশ মনে হয়েছে আমার কাছে। ওই কথার পর থেকে আমি ওনার সঙ্গে কোনো সীমানা রেখে মিশিনি।
‘তাণ্ডবে’র অভিজ্ঞতা…
শাকিব ভাইয়ের সাথে কাজের ব্যাপারটা আমার জন্য লাইফ টাইম অপরচুনিটি। শাকিব ভাইয়ের সিনেমায় শাকিব ভাই ছাড়া খুব একটা স্পেস থাকে না। অন্য ক্যারেক্টারের জন্য কম সময় থাকে। এসব ভাবতে ভাবতে অনেক আগেই ওনার সঙ্গে কাজের আশা মন থেকে বাদ দিয়েছিলাম। সে কারণে এই সিনেমার প্রস্তাবে কয়েকবার না করেছি৷ ক্যারেক্টরের বিষয় আমাকে বিস্তারিত বলা ছিল না। এরপর রায়হান রাফী আমাকে নিয়ে বসেছেন। পরে মনে হয়েছে ঠিক আছে। যেহেতু আমি রাফীর সাথেও কাজ করতে চাই। কমার্শিয়াল সিনেমার জন্য তিনি খুবই ভালো নির্মাতা৷ তিনিও (রাফী) আমাকে বলছেন, আমার শুরু করা উচিত৷ আমি ১২-১৩ দিন শাকিব ভাইয়ের সাথে শুটিং করেছি। ক্যামেরার পাশে দাঁড়িয়ে ওনাকে অভিনয় করতে দেখতাম। প্রথম দিন তো অবাক হয়েছি! জানি তিনি তার মতো করবেন কিন্তু এত ভালো পারফর্ম করবেন এটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। পরে মনে হয়েছে আমি আসলে বোকা। কারণ শাকিব ভাই তো পারফর্মার। তিনি তো ভালো করবেনই। তার অভিনয় দেখে মনে হয়েছে আমিও আমার সেরাটা দেব। ১২-১৩ দিনে কয়েকবার কথা হয়েছে ওনার সঙ্গে। কখনও ভাই আমার অভিনয় দেখেছেন। কখনও ভাই আগে করছেন সেটা দেখে আমি করেছি।

কী কথা হয়েছে শাকিব খানের সঙ্গে?
শাকিব ভাইয়ের সাথে অভিনয় নিয়ে কথা হয়নি। ওনার সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজছিলাম। ৭-৮ দিন শুট করার পর রাজশাহীতে একদিন ভাইকে একা দেখে কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে বললাম, আমার নাম রাকিব হোসেন ইভন। আপনার সাথে কাজ করছি এটা আমার সৌভাগ্য। ভাই জিজ্ঞেস করলেন, আমি কী করি। সবকিছু বললাম। এরপর জিজ্ঞেস করলেন, আর কী করো। বললাম, থিয়েটার করি। ওনি বললেন, হ্যাঁ, বোঝা যায়। আমার মনে হয়েছে ওনার এই মন্তব্য আমার জন্য অস্কার পুরস্কার। ওনার সাথে চার-পাঁচ মিনিট কথা বলেছি। এটা ছিল অদ্ভুত ঘোরের মতো। নেশার মতো। সত্যি কথা বলতে ওনার তুলনা উনি নিজেই। অনেক সময় অনেকে ট্রল করেন— শাকিব খান শাহরুখ খানের মতো এটা করছে ওটা করছে। আমরা যদি তাকে সম্মান না দিই তাহলে তো সারা পৃথিবী এসে আমার ভাইকে সম্মান দেবে না। আমি বিশ্বাস করি শাহরুখ খান ভারতের জন্য যত বড় সম্পদ, শাকিব খান আমাদের জন্য তার থেকে বড় অ্যাসেট।
অভিনয় নিয়ে স্বপ্ন কী?
আমি অভিনয়টা ভালোবাসি। এই একটা জিনিসই বুঝি বা বোঝার চেষ্টা করি। এটা নিয়ে শেষ পর্যন্ত থাকতে চাই। থিয়েটার করি, টুকটাক নাটক করি, ওটিটি-সিনেমাও করি। দেশের মধ্যে সবকিছুই করা হয়ে গেছে। এটা আরও বহুদিন চালিয়ে যেতে চাই। দেশের হয়ে দেশের বাইরে কিছু করার ইচ্ছাটা বেশি। আমি চাই আমার দেশে এমন সিনেমা হোক যে সিনেমার একটা অংশ আমি হব। বাইরের দেশে গিয়ে যেন বলতে পারি এটা আমার দেশের সিনেমা। সেটা হোক কান চলচ্চিত্র উৎসব কিংবা অস্কার পুরস্কার। আমি জানি এটা অদ্ভুত বা পাগলামি। কিন্তু আমরা যদি স্বপ্নই না দেখি তাহলে কীভাবে যাব। আমি একটু বেশি স্বপ্ন দেখি।
শুরুর গল্পটা শুনতে চাই।
ছোটবেলায় সাদাকালো টেলিভিশন ছিল। এটা দেখেই বড় হওয়া। তখন থেকে স্ক্রিন ভালোবাসি। স্ক্রিনে থাকার অনেকগুলো মাধ্যম রয়েছে। পরে আস্তে ধীরে অনুভব করলাম। আমার আগ্রহ অভিনয়ে। অভিনয় এমন একটা জিনিস যেখানে আমি কখনও বিরক্ত হব না। মানুষ জানতে এবং মানুষের জীবন জানতে আমার খুব ভালো লাগে। ওখান থেকে সিদ্ধান্ত নেই অভিনয় করব। এইচএসসি পরীক্ষার পর থিয়েটারে কাজের সুযোগ আসে। আমার বোনের সাথে গিয়ে থিয়েটারে গিয়ে যোগ দিই। এরপর থেকে ১৩-১৪ বছর থিয়েটার করে যাচ্ছি। মিডিয়ায় ঢুকব বলে থিয়েটারে গিয়েছিলাম। কিন্তু থিয়েটারে অভিনয় শিখতে শিখতে মিডিয়া ভুলে গিয়েছিলাম। থিয়েটার থাকাকালীন নিকেতনে দুই একটা কাজ হতো। আমাদের ডাকত। আমি অভিনয় শুরু করি ব্যাকগ্রাউন্ড আর্টিস্ট হিসেবে। একটা চুইংগামের বিজ্ঞাপনে। আড়াই শো জনের একজন ছিলাম। ওখান থেকেই আমার ক্যারিয়ার শুরু। এরপর আস্তে আস্তে এ পর্যন্ত আসা।
বর্তমান ব্যস্ততা…
আপাতত ব্যস্ততা নেই। কিছু কাজ নিয়ে কথা চলছে। দুই সিনেমা এ বছর মুক্তির অপেক্ষায় আছে। একটা ‘নাদান’, অন্যটা ‘চারুলতা’।
আরআর

