স্টান্টম্যানদের কাঁধে ভর করে সিনেমায় অতিমানবীয় ও দুঃসাহসী দৃশ্যে বাহবা কুড়ান নায়ক-নায়িকা-খলনায়ক। দিন শেষে ডামিদের ভাগ্যে জোটে অবহেলা। এসব দৃশ্যে অংশ নিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হলে তবে যেন পড়তে হয় অকূল পাথারে। পাশে পান না কাউকে। এরকমটাই জানা গেল ঢালিউডের অভিজ্ঞ কয়েকজন স্টান্টম্যানের সঙ্গে কথা বলে।
২৮-২৯ বছর ধরে ঢালিউডে সুমন রেজা জুম্মন। আগে স্টান্টম্যানের কাজ করতেন। এখন ফাইট ডিরেক্টর। শুরুতেই জানালেন ঢালিউডের স্টান্টম্যানদের অবমূল্যায়ন ও অবহেলার কথা।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের স্টান্টম্যানরা অবহেলিত। আগেও শিল্পী হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়নি এখনও পাই না। অনেকবার দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি। শরীরে কাটা দাগের অভাব নেই। কিন্তু দুর্ঘটনার পর কখনও কাউকে সেভাবে পাশে পাইনি। বড়জোর তাৎক্ষণিক চিকিৎসা এবং এক সপ্তাহের ঔষধ কিনে দিয়েছে। এরপর আর কেউ কোনোদিন খোঁজ নেয়নি। অথচ বিশ্বের সব দেশে স্ট্যান্টম্যানদের আলাদা টেক কেয়ার করা হয়। যে প্রযোজনা সংস্থার কাজ করতে গিয়ে আমরা আহত হই নৈতিকভাবে সব দায়িত্ব কিন্তু তাদের। তবে বাংলাদেশের ইন্ডাস্ট্রিতে এগুলো মানা হয় না।’
স্টান্টম্যান হিসেবে কাজ করতে গিয়ে জুম্মন নিজেও ঘুরে এসেছেন মৃত্যুর মুখ থেকে। যে সিনেমায় দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন ওই সিনেমার প্রযোজক, নায়কসহ সংশ্লিষ্ট কাউকে পাশে পাননি বলে জানান।
তার কথায়, ‘‘আমি সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনার শিকার হই ২০১২ সালে। ‘এক মন এক প্রাণ’ নামের সে সিনেমার পরিচালক ছিলেন সোহানুর রহমান সোহান। কাজটি করার সময় আমার শরীরের পেছনে একটি গ্লাস ঢুকে যায়। বড় গ্লাসটা টান দিয়ে বের করা হলেও একটি টুকরো ভেতরে থেকে যায়। পরে তিনবার অপারেশন করে ওই কাচ বের করা হয়।’’
বিজ্ঞাপন
‘সেদিন প্রথমে আমাকে মেট্রোপলিটন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওরা ব্যর্থ হলে মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১২ দিন ছিলাম। চিকিৎসক পরামর্শ দিয়েছিলেন ৬ মাস বিশ্রামে থাকার। কিন্তু প্রযোজনা সংস্থা আমাকে ছয় দিনের খরচও দেয়নি। এ ধরনের ঘটনায় পুলিশ কেস হয়। সে কেস মেটাতেও নিজের পকেট থেকে ১২০০ টাকা দিতে হয়েছে। দুর্ভাগ্য ওই সময় আমাদের সিনেমার নায়ক, পরিচালক, প্রযোজক— কেউ আমাকে একটা নজর দেখতেও যাননি। আমি মরেই যেতাম। ডাক্তার বলেছিলেন তোমাকে আর বাঁচানো যাবে না।’
স্টান্টম্যান হিসেবে ইমন আনোয়ারের অভিজ্ঞতার ঝুলি বেশ ভারি। কেননা দেশের পাশাপাশি দক্ষিণী সিনেমায় কাজ করেন তিনি। অভিজ্ঞতা রয়েছে ইংরেজি সিনেমায় কাজেরও। তিক্ত অভিজ্ঞতা তার যা হয়েছে সব নিজের দেশের চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে।
সে নিষ্ঠুরতার ফিরিস্তি দিতে গিয়ে বললেন, ‘এমন কোনোদিন নেই এমন কোনো সিন নেই আমরা (স্টান্টম্যানরা) আঘাত পাই না। সেসব নিয়েই কাজ করতে হয়। আহত হলে অনেকে নাম কামানোর জন্য সঙ্গে থাকেন। প্রাথমিক চিকিৎসা আর অল্প কিছু খরচ দেন। তোমার জন্য আমরা এই করব, ওই করব— আশ্বাসও দেন। কিন্তু পরে আর খোঁজ নেন না। যোগাযোগ করলে এমন আচরণ করেন মনে হয় আমরা ওনাদের কাছে বোঝা। দুর্ব্যবহার করেন। শুধু ব্যতিক্রম দেখেছি জসিম ভাই ও মান্না ভাইয়ের ক্ষেত্রে। ওনারা খোঁজ খবর রাখতেন। এখনকার নায়করা কেউ সেরকম না।’
তিনি বলেন, ‘শুটিংয়ে আমরা যে গ্লাসগুলো ভাঙি এগুলো ঘরের জানালায় ব্যবহার করা আসল গ্লাস। এ ধরনের দৃশ্যের জন্য ৫-৬ হাজার টাকার চুক্তি হয়। আমরা ধরেই নেই হাতে-মুখে কাচ ঢুকবে। বাকিটা আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে করি। অনেক সময় ক্ষতি ছাড়াই কাজ শেষ করা যায়। তখন শুরু হয় আরেক উৎপাত। প্রযোজক এসে বলেন, ভাই আজ টাকা কম আছে, আপনার পারিশ্রমিক আগামীকাল দেব। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এভাবে বকেয়া পড়া পারিশ্রমিকের টাকা আর পাওয়া যায় না। যেগুলো পাই সেগুলো তুলতেও জুতার তলি ক্ষয় করতে হয়।’

২০১৫ সাল থেকে ২৪ পর্যন্ত দক্ষিণী সিনেমায় স্টান্টম্যানের কাজ করেছেন জুম্মন। ঢালিউডের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, ‘আমরা যেভাবে শট দিই তা পৃথিবীর কোনো জায়গায় এভাবে দেয় না। আমি নিজে তার প্রমাণ। আমরা বাংলাদেশে অরজিনাল গ্লাস, বোতল ভাঙি যা খুব ঝুঁকিপূর্ণ ও অমানবিক। দক্ষিণী সিনেমায় স্টান্টম্যানদের এরকম ঝুঁকিতে ঠেলে দেওয়া হয় না।’
এ সময় দক্ষিণী সিনেমার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘যেখানে স্টান্টম্যান শট দেবে প্রযোজক, নির্মাতা, ফাইট ডিরেক্টর আগে জায়গাটা পর্যবেক্ষণ করেন। ওই দৃশ্যে অভিনয় করতে কতটুকু জায়গা দরকার সেসব দেখেন। এরপর ওই স্থানে ওই রঙের ম্যাট দিয়ে দৃশ্য ধারণ করা হয়। তারা শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তারপর শুটিংয়ে নামেন।’
ঢালিউডে সীমাবদ্ধতার খেসারতও দিতে হয় স্টান্টম্যানকে। এরকম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি অ্যাকশন দৃশ্যে একটি ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়। ফলে তিন অ্যাঙ্গেল থেকে দৃশ্যটি ধারণ করতে এক শট তিনবার নেওয়া হয়। তখন আমাদেরও একই ঝুঁকিপূর্ণ শটে তিনবার অংশ নিতে হয়। অন্যদিকে দক্ষিণে এক শটে সর্বনিম্ন তিনটি ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়। ফলে বাড়তি পরিশ্রম বা ঝুঁকি নিতে হয় না।’
ইমন যোগ করেন, ‘সেখানকার শুটিং সেটে সবসময়ের জন্য একজন ডাক্তার থাকেন, অ্যাম্বুলেন্স থাকে। যদি কোনো ফাইটার বা আর্টিস্ট অসুস্থ বা আঘাত প্রাপ্ত তাহলে তার যতদিন সুস্থ হতে সময় লাগে ততদিন সব চিকিৎসা দেয় প্রযোজনা সংস্থা। আর যদি দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কারও মৃত্যু হয় তাহলে প্রযোজনা সংস্থা থেকে তার পরিবারকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দেওয়া হয়।’
বাংলাদেশে কি এরকম ব্যবস্থা আছে জানতে চাইলে ইমন শ্লেষের হাসি হেসে বলেন, ‘পারিশ্রমিকের টাকাই ঠিকমতো দিতে চায় না আবার ডাক্তার!’
স্টান্টম্যান মাসুদ খানও একই কথা বললেন। তার ভাষ্য, ‘চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত আছি ২৬-২৭ বছর। সালমান শাহ ছাড়া সব হিরো-হিরোইনের সঙ্গে কাজ করেছি। আমরা স্টান্টম্যানরা যতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হই ততটুকু সার্বিক সহযোগিতা পাই না। কাজ করতে গিয়ে আমি নিজেই অনেকবার আহত হয়েছি। চোখে, পিঠে কাচ ঢুকেছে। কিন্তু সেজন্য কখনও প্রযোজনা সংস্থা থেকে পরিপূর্ণভাবে চিকিৎসা খরচ পাইনি। বিভিন্ন সময় অনেক সহকর্মীদের দেখেছি আহত হয়ে পাঁচ-ছয় মাস ঘরে পড়ে থাকতে। চিকিৎসা তো দূরের কথা খরচ তো দূরের কথা কেউ দেখতেও যায় না। ব্যতিক্রম খুব কম দেখা যায়।’
এদিকে শনিবার (৩ এপ্রিল) অসুস্থ হয়ে মৃত্যু হয়েছে স্টান্টম্যান মনির হোসেনর। তিনি ‘‘তাণ্ডব’ সিনেমায় স্টান্টম্যান হিসেবে কাজ করছিলেন। ছবির প্রযোজনা সংস্থা এসভিএফ আলফা-আই এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেড। মৃত মনিরকে নিয়ে পরিকল্পনা রয়েছে আলফা আইয়ের কর্ণধার শাহরিয়ার শাকিলের। তিনি বলেন, ‘অবশ্যই আমাদের পরিকল্পনা আছে। কেননা মনির আমাদের সহকর্মী ছিলেন। আপনি হয়তো জানেন শনিবার (৩ মে) মনির অসুস্থ হলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে আমরা গাড়িতে করে রাজশাহী মেডিকেলে নিয়ে যাই। পরে সেখান থেকে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, তিনি মারা গেছেন। এরপর তার মরদেহ ঢাকায় পরিবারের কাছে পাঠানো, জানাজাসহ যাবতীয় কাজে সঙ্গে ছিলাম। তার পরিবারের প্রতি আমাদের সহানুভূতির জায়গা অবশ্যই আছে। ওই জায়গা থেকেই তাদের সঙ্গে বসব। কথা বলে আমাদের করণীয় যেটা সেটা করব।’’

