গেল ৮ নভেম্বর মুক্তি পেয়েছে ওয়েব সিরিজ ‘রঙিলা কিতাব’। পাতায় পাতায় মুগ্ধতা। প্রদীপ, সুপ্তি, নওরোজ শাহ, জাহাঙ্গীর, আজম— যেন একেকটি রঙিন পৃষ্ঠা। যেগুলো নিয়ে দক্ষ হাতে ‘কিতাব’ বাঁধাই করেছেন অনম বিশ্বাস। ঢাকা মেইলের সঙ্গে কথোপকথন জমেছিল এই ক্যাপ্টেন অব দ্য শিপের।
‘রঙিলা কিতাব’ এরকম সাড়া জাগাবে— প্রত্যাশা করেছিলেন?
বিজ্ঞাপন
এটা আগে থেকে নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে দর্শকের ভালো লাগবে— নিজের কাজ নিয়ে এরকম প্রত্যাশা প্রত্যেক পরিচালকের থাকে। আমারও ছিল। চেষ্টা করেছি গল্প যেন ঝুলে না যায়। বিভিন্ন ঘটনা যেন একের পর এক ঘটতে থাকে এবং দর্শক যেন নিজেদের যুক্ত রাখতে পারেন। তারা যেন এক বসায় সিরিজটা দেখেন।
নেটজেনরা দাবি তুলেছে ‘রঙিলা কিতাবে’র দ্বিতীয় কিস্তির। কী বলবেন তাদের?
আমিও চাই ‘রঙিলা কিতাবে’র দ্বিতীয় কিস্তি আসুক। সেটি প্রথম কিস্তির মতো ঘটনাবহুল ও উত্তেজনাপূর্ণ করা সম্ভব। দর্শকরাও চাইছেন। প্রযোজনা সংস্থাও যদি মনে করে তবে অবশ্যই দ্বিতীয় কিস্তি আসবে।
বিজ্ঞাপন
সিরিজটির অ্যাকশন নিয়ে বেশ প্রশংসা হচ্ছে। এর কারণ কী বলে মনে হয় আপনার?
ভালোলাগার কয়েকটি কারণ আছে বলে আমার মনে হয়। বাস্তবসম্মত অ্যাকশন দেখানোর চেষ্টা করেছি। কেননা একজন লোকাল গ্যাংস্টারের মারামারির বিভিন্ন কৌশল না জানার সম্ভাবনা বেশি। সে স্বভাবগতভাবেই মারপিট করে। চেষ্টা করেছি রাস্তার মারামারির একটু নতুন সংস্করণ করতে। ওটার ভেতর একটু স্টাইল রাখতে। শারীরিকভাবে অসম্ভব শক্তিশালী ও সহনশীল মানুষ প্রদীপ। অনেক মার খেলেও সহজে ভেঙে পড়ে না। অ্যাকশনেও ব্যক্তিত্বটা রাখার চেষ্টা করেছি। মারামারি দেখতে অনেকটা ইউনিক মনে হওয়ার আরেকটি কারণ এটা অন্য কোনো স্টাইলের কপি না। কোনো সিনেমা থেকে টুকে নেওয়া হয়নি। নতুন সিনেমাটিক স্টাইল তৈরির একটি ক্ষুদ্র চেষ্টা। ভবিষ্যতে যদি কোনো অ্যাকশন দৃশ্যের আয়োজন করি তবে এটি আরও বড় পরিসরে হবে। মারামারিতে স্লো মোশন নেই। যেন সত্য মনে হয়। এটাও আলাদা মনে হওয়ার একটি কারণ। হয়তো সেজন্য দর্শকের মনে দাগ কেটেছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম অ্যাকশনের নতুন একটি ঘরানা তৈরি করতে। আমি ও আমার কোরিওগ্রাফার লায়ন প্রতিনিয়ত কথা বলে অ্যাকশনের প্রতিটি ধাপ ঠিক করেছি। বাস্তবসম্মত মারপিটে আসলে কী ঘটার কথা তা মাথায় রেখে ধরে ধরে করা হয়েছে। অনুশীলনও করা হয়েছে।
নয়নাভিরাম লোকেশন দেখা গেছে ‘রঙিলা কিতাবে’। এরকম জায়গায় দৃশ্যধারণে প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতা কীরকম ছিল?
লোকেশনের ব্যাপারে আমি কখনও ছাড় দিতে চাই না। বাজেট সবসময় বলে তুমি ছাড় দাও। আমিও ভাবি দুটি টাকা আমার থাকবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মন সায় দেয় না। ‘ভাইরাস’ কিংবা ‘দুই দিনের দুনিয়া’ যদি দেখেন তাহলে বুঝবেন আমি সবসময় ইউনিক লোকেশনে যাওয়ার চেষ্টা করি। এবারও সেরকম চেষ্টা করছি। তবে মনমতো লোকেশন পেতে অনেক খুঁজতে হয়। এটা এক বেলার কাজ না। স্বরূপকাঠিতে কাজ করার সিদ্ধান্তে আসতে আরও দুই-তিন জেলা ঘুরতে হয়েছে। আমি চেয়েছি এটা উপজেলা শহরের গল্প হোক। গল্পটা নব্বই দশক থেকে অনুপ্রাণিত। আজকাল মানুষজন কোনো অঘটন ঘটানোর পর বিদেশ চলে যায়। সেসময় বিদেশ এত সহজ ছিল না। দেশের বিভিন্ন স্থানে গা ঢাকা দিতে হতো। বিদেশ ছাড়াও যে লুকিয়ে থাকা যায় সেটা দেখাতেই এরকম লোকেশন খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। তবে প্রচুর ব্যয় ও শ্রম সাপেক্ষ। পুরো টিম নিয়ে ঘোরা, লোকেশন দেখা— কম ঝাক্কির না। এসব জায়গায় সমস্যাও অনেক। থাকার জায়গা পাওয়া যায় না। টিম বড় হলে অসুবিধা বাড়ে। আমার টিমের বেশিরভাগ মানুষ বরিশাল শহরে থেকেছেন। সেখান থেকে স্পটে যেতে লেগেছে এক ঘণ্টার মতো। আমি স্বরূপকাঠিতেই থেকেছি। এত সুন্দর লোকেশন যে দিনশেষে মনে হয় কষ্ট সার্থক হয়েছে।
সিরিজের শেষটা দর্শকের প্রত্যাশিত ছিল না বলে অভিযোগ আছে। অনেকের মতে গল্পের চেয়ে নির্মাণ বেশি শক্তিশালী হয়েছে। বিষয় দুটি নিয়ে কী বলবেন?
প্রদীপের মারা যাওয়াটা দর্শকের প্রত্যাশিত না। সুপ্তির সন্তান প্রসব, প্রদীপের মারা যাওয়া, জন্ম-মৃত্যুর যে ঘটনা— আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। এই যে অদ্ভুত ধরনের শূন্যতা সেই বোধটা দর্শকের ভেতর তৈরি হলো। অনিশ্চয়তা এবং জীবনের সৌন্দর্য অর্থাৎ একজন মারা গেল আরেকজন জন্ম নিল এক সম্ভাবনার শেষ আরেক সম্ভাবনার শুরু হলো। আমরা চাই বা না চাই এটাই তো জীবনের অংশ। আমার কাছে মনে হয় ট্রাজেডি অনেক বেশি ট্রিগার করে মানুষকে। আর গল্প ও মেকিং হাত ধরে চলে। ভালো গল্প ছাড়া ভালো নির্মাণের সম্ভাবনা কখনও থাকে না। ভালো গল্পের মধ্যমে মধ্যম মানের নির্মাণ অনেক দূর নেওয়া যায় কিন্তু খারাপ স্ক্রিপ্টের ভালো নির্মাণ কখনও সম্ভব না। ওই জায়গা থেকে এভাবে আমি কখনও ভাবি না।
‘আয়নাবাজি’র চিত্রনাট্যকার কিংবা ‘দেবী’, ‘দুই দিনের দুনিয়া’, ‘রঙিলা কিতাবে’র নির্মাতা— সর্বত্র আপনি সফল। তবুও নিভৃতচারী কেন?
আমার ব্যক্তিত্বই এরকম। কিছুটা ইন্ট্রোভার্ট। কিন্তু আমার কাজটা ইন্ট্রোভার্টদের জন্য সহজ না। নিজের ভেতরে থাকতে পছন্দ করি। কাজ ছাড়া অনেক সোশ্যাল গ্যাদারিংয়ে আরামবোধ করি না। সবার সঙ্গে সহজে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা যেকোনো কারণে আমার একটু কম। তার মানে এই না যে মানুষ অপছন্দ করি। হয়তো এক ধরনের জড়তা কাজ করে। ওই জায়গা থেকে আমি সামাজিক মাধ্যমেও আমি অতটা সক্রিয় না। কাজের সময় নূন্যতম যেটুকু সময় না দিলেই নয় সেটুকুই দেওয়ার চেষ্টা করি।
বর্তমান ব্যস্ততা…
স্বাধীন বাংলা ফুটবল নিয়ে নির্মিত ‘ঠিকানা বাংলাদেশ’ সিনেমার পোস্ট প্রডাকশনের কাজ চলছে। ছবিটির ওয়ার্কিং টাইটেল ছিল ‘ফুটবল ৭১’। ছবির টাইটেল ট্র্যাক করেছি। ইমন চৌধুরীর সুর করেছেন। ওখান থেকে মনে হয়েছে ‘ঠিকানা বাংলাদেশ’ নামটি উপযুক্ত। কাজটি ধীরে চলার কারণ অনুদানের অর্থ সিনেমার জন্য পর্যাপ্ত না। তাই গাঁটের পয়সা খরচ করে করতে হচ্ছে। বিভিন্ন কাজ করে যে টাকা পাচ্ছি সেখান থেকে একটু একটু করে কাজ চালাচ্ছি। আশা করছি সামনের বছর মুক্তি দেব। এছাড়া ওটিটি মাধ্যম চরকির মিনিস্ট্রি অব লাভের ‘শোল্ডারম্যান’ নিয়ে ব্যস্ততা আছে। গল্প ঘষামাজা করছি। ‘রঙিলা কিতাবে’র জন্য ওটা থেমে ছিল। পাশাপাশি আরও বেশকিছু কাজ নিয়ে কথা হচ্ছে।
আরআর