জনপ্রিয় অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরীর আকাশ প্রতিনিয়ত প্রসারিত হচ্ছে। সেখানে মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে উড়ে অভিনয় প্রতিভা মেলে ধরছেন তিনি। মুগ্ধতার সবগুলো পাপড়ি মেলে অভিনেত্রী এবার সুবাস ছড়াচ্ছেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। প্রথম সিনেমা ‘সাবা’র বিশ্বভ্রমণের পর দ্বিতীয় সিনেমা ‘প্রিয় মালতী’ ডাক পেয়েছে মিশরের কায়রো চলচ্চিত্র উৎসবে। ক্যারিয়ারের এই ভরা বসন্তে ঢাকা মেইলের কাছে মেহজাবীন খুলেছিলেন মনের আগল।
সিনেমায় নাম লিখিয়েছেন যেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খ্যাতি অর্জনের জন্যই। ‘সাবা’র পর ‘প্রিয় মালতী’র উৎসবে জায়গা পাওয়া যেন সে কথাই বলছে…
বিজ্ঞাপন
আমি তো আসলে বাংলা সিনেমা করেছি। সেগুলা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য বাড়তি পাওয়া বলে মনে করছি। আশা করছি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সফর শেষে সিনেমাগুলো দেশে মুক্তি দেওয়া যাবে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একের পর এক অর্জন— কীরকম আন্দোলিত করছে?
এ ধরনের অভিজ্ঞতা আমার জন্য নতুন। প্রথম সিনেমা নিয়ে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রণ পাওয়া। দ্বিতীয় সিনেমার ক্ষেত্রেও একই চিত্র। আমাকে ভীষণ আন্দোলিত করছে। দেশের গল্পগুলো আন্তর্জাতিক মানের হচ্ছে এবং বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে সেরাদের তালিকায় জায়গা নিচ্ছে। এটা আমাদের ইন্ডাস্ট্রির জন্য বড় অর্জন। বাংলাদেশের নাম দূর দূরান্তে পৌঁছে দেওয়াটা আমাদের জন্য গর্বের। ইন্ডাস্ট্রিকে আন্তর্জাতিকভাবে সবাই চিনবে। তরা বুঝবেন এদেশেও বিশ্বমানের কাজ হচ্ছে। এই অর্জন আমাকেও একজন অভিনয়শীল্পী হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত করে তুলছে। বিভিন্ন উৎসবে যোগ দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছি। হলিউডসহ বিভিন্ন দেশের অভিনয়রশিল্পীরা থাকছেন। তাদের সঙ্গে একই মঞ্চে দাঁড়ানোর সুযোগ হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
আমি জানি সিনেমাগুলো মুক্তি দিতে দেরি হওয়ায় এক ধরনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু বাইরে থেকে বাড়তি অর্জনে আমাদের প্রাপ্তির ঝুলি ভরছে। তাই দেশে মুক্তির ক্ষেত্রে বলব ভালো কিছুর জন্য দেরি হলে সমস্যা নেই।
‘সাবা’ ও ‘প্রিয় মালতী’র চরিত্র দুটিতে কতটা সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য রয়েছে বলে মনে করছেন?
‘সাবা’ ও ‘প্রিয় মালতী’ সিনেমা দুটিতে আমার দুই চরিত্রের জার্নি দুই রকম। চাওয়া পাওয়া এক না, জীবন যুদ্ধ আলাদা, চাহিদা ভিন্ন। ওই জায়গা থেকে একেবারেই আলাদা করে চরিত্রগুলোতে ঢুকতে পেরেছি। বাচনভঙ্গিসহ সবক্ষেত্রে নিজেকে যতখানি আলাদা করা যায়, সুন্দর করে উপস্থাপন করা যায়— চেষ্টা করেছি।
চরিত্র দুটির জন্য প্রস্তুতি কেমন ছিল?
আমি মনে করি একার প্রস্তুতি দিয়ে কিছু হয় না। পুরোটাই টিমওয়ার্ক। এই দুই সিনেমার ক্ষেত্রেই তাই। টিমের সকলের প্রচেষ্টা আছে। আমি নিজের জায়গা থেকে চেষ্টা করেছি। তাছাড়া আমাকে কীভাবে আলাদা করা যায়— অঙ্গভঙ্গি, বাচনভঙ্গি থেকে শুরু করে সবকিছুতে পেছনে সময় এবং শ্রম দেওয়া হয়েছে। পরিচালক থেকে শুরু করে প্রত্যেক সেক্টরে যারা আছেন আর্টে, মেকআপে যারা কাজ করছেন— সবার অবদান আছে। এই সম্মিলিত অবদানের কারণেই আমার পক্ষে সম্ভব হয় এক চরিত্র থেকে অন্য চরিত্রকে আলাদা করার।
দুটি সিনেমাই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমন্ত্রণ পেয়েছে। এরকম লক্ষ্য নিয়েই কি সিনেমা বাছাই করছেন?
কিছুটা হ্যাঁ, কিছুটা না। একটি সিনেমা হাতে নেওয়ার ক্ষেত্রে সবার আগে থাকে গল্প পছন্দের বিষয়। কে পরিচালনা করছেন, সহশিল্পী কারা, পুরো টিমে বিভিন্ন বিভাগে কারা কাজ করছেন— সবগুলো বিষয় সমান গুরুত্ব পায়। আমার চরিত্র কেমন, আমার জন্য কতটুকু ঠিক, কতটা সুন্দর করে তুলে ধরতে পারব— সেগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। কাজ শেষ হলে এক ধরনের অনুভূতি কাজ করে। সেসময় ভাবি, দেশের বাইরের দর্শক এটার সাথে নিজেদের কীরকম যুক্ত করতে পারবে। ‘সাবা’ ও ‘প্রিয় মালতী’র ক্ষেত্রে মনে হয়েছে গল্পগুলো আমাদের দেশে অবশ্যই বলব, তবে বাইরের দর্শকদেরও দেখা উচিত। তারা কি নিজেদের এর সঙ্গে যুক্ত করতে পারে কি না। বাইরে আমাদের অবস্থানটা আসলে কেমন। এসব ভেবেই সাবমিশন করা। যখন সুখবরগুলো আসছে তখন মনে হচ্ছে আমরা কিছুটা হলেও এগিয়ে গেছি। বাইরের দেশের সিনেমার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে যাচ্ছি। তবে আমাদের প্রাথমিক ইচ্ছা কিন্তু একেবারেই তা না। আমরা চেয়েছি একটি গল্প বলতে যেটা দেশের গল্প এবং দেশের মানুষের জন্য। তা যখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জায়গা পায় তখন বাড়তি অর্জন হিসেবে ধরা দেয়।
কয়েকটি আন্তর্জাতিক উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে ‘সাবা’। সেখান থেকে এরকম কোনো প্রশংসাসূচক মন্তব্য কি মনে আছে যা আপনাকে খুব বেশি অনুপ্রাণিত করেছে?
হ্যাঁ, অবশ্যই এরকম হয়েছে। আমরা সিনেমাটা বানিয়েছে বাংলা ভাষায়। আমি মনে করেছি টরেন্টোর জন্য ঠিক আছে যেহেতু সিলেকশন হয়েছে। কিন্তু সাবটাইটেল পড়ে আমাদের অনুভূতি, ভাবনাগুলো তারা কতটুকু বুঝতে পারবেন— সংশয় ছিল। কিন্তু প্রদর্শনের পর দেখলাম ক্রিটিকদের সবাই সাবটাইটেল পড়েই বুঝতে পারছেন। প্রতিটি ইমোশনের সঙ্গে রিয়্যাকশন দিচ্ছেন। তখন বুঝলাম আমাদের ভাবনা ভুল। প্রদর্শনী শেষে প্রশ্নোত্তর পর্ব থাকে। সেখানে অসংখ্য প্রশ্ন, কৌতুহল ও মন্তব্য ছিল। যেগুলোর ৯৯ শতাংশই প্রশংসা হিসেবে ধরা দিয়েছে। নির্দিষ্ট করে কোনো মন্তব্য মনে নেই তবে অধিকাংশই এরকম ছিল— আমি চরিত্রের গভীরতা খুব ভালোভাবে ক্যারি করতে পেরেছি। তখন মনে হয়েছে ভালো কিছুই হয়েছে তাহলে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের কাজ নিয়ে বিচরণ একজন অভিনয় শিল্পীর চিন্তা-ভাবনার ওপর কতটা প্রভাব ফেলে?
অনেক বেশি প্রভাব ফেলে। বলে বোঝানো যাবে না। এখানে তো শুধু আমি-ই সিনেমা নিয়ে যাচ্ছি না। অন্য সিনেমাগুলোও আসছে। সেগুলো দেখার সময় মনে হয় আমরা আসলেই অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের আরও গল্প বলার আছে। আমাদের গুণী নির্মাতা আছেন, মেধা আছে। তাদের সেই গল্পগুলো বলতে সুযোগ দেওয়া উচিত। তারা যদি সুযোগ পান, মেধাটাকে যদি পুরোপুরি কাজে লাগানো যায় তাহলে অল্প কয়েকটা না প্রতিবছর অনেকগুলো সিনেমায বাইরের সিনেমার সঙ্গে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জায়গা করে নেবে। কথায় আছে, বাইরে গিয়ে চোখ খুলে যায়। আসলেই তাই। বাইরের দেশের গল্প বলার ধরন, স্টাইল দেখলে চিন্তা ভাবনা এত ওপরের দিকে যেতে থাকে যে বোঝানো যাবে না।
আপনার অনুরাগীরা কিছু দাবি রেখেছেন। সেসব আদায়ে প্রয়োজনে শাহবাগে যেতে চান তারা। এ বিষয়ে কিছু বলার আছে আপনার?
এটা দেখেছি। মজা-ই লেগেছে। তবে ব্যাপারগুলো শাহবাগ যাওয়ার মতো কিছু না বলে মনে করি। ফ্যানদের জন্যই তো কাজ করা। তারা যদি এরকম দাবি রাখেন তাহলে অবশ্যই সেটা মাথায় নেওয়া উচিত। সেটা নিয়ে ভাবছি। আশা করি মনের মতো কাজ উপহার দিতে পারব তাদের।
ওটিটি-সিনেমায় থিতু হওয়ায় নাটকে দেখা যায় না আপনাকে। আগের মতো পর্দায় উপস্থিতি নেই দেখে কেউ কেউ বলছেন, মেহজাবীনের হাতে কাজ নেই। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
কেউ যদি সেরকম মনে করে, করুক। দুটি সিনেমা শেষ করেছি। একমাস আগে ওটিটিতে কাজ রিলিজ হয়েছে। আমি এই গতিতেই চলতে চাই। এতে যদি কেউ কিছু মনে করে আমার কিছু বলার নেই। সবসময় নিজের ইচ্ছায় কাজ করেছি। যখন অনেক বেশি কাজ করার ইচ্ছা ছিল তখন বেশি করেছি। তখন বলেছে আমি অনেক বেশি কাজ করছি। সব কাজগুলো মেহজাবীন কেন করছে। আর এখন কম করে কাজ করতে চাচ্ছি, বছরে এক-দুইটা কাজ করছি, ভালো ও বড় বাজেটের কাজ করতে চাচ্ছি— এটাও আমার ইচ্ছা। কাজগুলো দর্শকের মন ছুঁতে পারছে কি না সেটাই বড় প্রশ্ন। আমার যে স্ক্রিপ্ট যে মাধ্যমে করার সুযোগ থাকবে সে মাধ্যমেই করব। যেটা নাটকে করলে মানুষের কাছে পৌঁছাবে মনে হবে সেটা নাটকে করব। ওটিটি মাধ্যমে মনে হলে তাই করব। আর যদি মনে হয় সিনেমার মাধ্যমে হলে দেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছাপ রাখতে পারে তাহলে সেভাবে করব। আর একটা শ্রেণি থাকবেই। তাদের অনেক প্রশ্ন থাকবে। কিন্তু তাদেরকে কখনও খুশি করা যাবে না। সেটা আমি মাথায় নিতে চাই না। আমার গতিতে আমার ইচ্ছামতো কাজ করে এসেছি এভাবেই পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি কাজ করব।
মিশর কবে যাচ্ছেন?
এখনও নিশ্চিত না। সুসংবাদ তো সবে পেলাম। দেখা যাক যাওয়া যায় কি না। তবে ইচ্ছা আছে।
আরআর