গেল জুলাই উত্তাল ছিল বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে। গণহত্যার বিপরীতে ও শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের দাবিতে এক হয় শ্রেণি পেশা নির্বিশেষে। শিল্পীরাও ছিলেন এই দলে। ফলে স্থবির ছিল নাট্যাঙ্গন। বন্ধ ছিল শুটিং। সরকার পতনের পর নতুন আশায় বুক বেঁধে পথ চলতে প্রত্যয় নিতেই প্লাবিত দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল। বানভাসিদের পাশে দাঁড়াতে ফের এক হন শিল্পীরা। দুর্গত অঞ্চলে চলে যান সহায়তা পৌঁছে দিতে। ফলস্বরুপ জুলাইয়ে বন্ধ হওয়া ক্যামেরা-লাইট আর জ্বলে ওঠেনি।
সম্প্রতি ফের শুটিংয়ের গুনগুন শুরু হলেও অনেকের মতে গত দুই মাসের মোটা অঙ্কের লোকসান হয়েছে নাট্যাঙ্গনে। সেই পরিমাণ কত এবং তা কাটিয়ে তুলতে কতদিন প্রয়োজন— উত্তর খুঁজতে ঢাকা মেইল কথা বলেছেন অভিনয় শিল্পী সংঘ ও টেলিপ্যাবের নেতৃত্বস্থানীয়দের সঙ্গে।
বিজ্ঞাপন
অভিনয় শিল্পী সংঘের সভাপতি আহসান হাবিব নাসিম বলেন, ‘লোকসানের পরিমাণ আমার পক্ষে বলা সম্ভব না। প্রডিউসাররা ভালো বলতে পারবেন। তবে অনেকের কাছে শুনছি যারা চরিত্রাভিনেতা আছেন, যাদের আর কোনো পেশা নেই, এটার ওপরই নির্ভরশীল— তারা বিপদের মধ্যেই আছেন। যারা প্রান্তিক; মাসে পাঁচ দিন দশ দিন শুটিং করে সংসার চালান— তাদের কথা বলছি। পরিস্থিতি যদি ঠিকঠাক না হয় তবে অনেক শিল্পী বিপদে পড়ে যাবেন।’
সংঘের এ নেতা বলেন, ‘জুলাইয়ের পর শুরু হলো বন্যা। প্লাবিত দেশের পূর্বাঞ্চল। সেখানে শিল্পীদের সবাই সহায়তা নিয়ে যাচ্ছেন। এসব কারণে মিডিয়া স্থবির আছে এখন। তাছাড়া মানুষ এখন খবর দেখতেই বেশি আগ্রহী। যে কারণে শুটিংও কম হচ্ছে। তবে সম্প্রতি শুটিং শুরু হয়েছে। খুব বেশি না কিন্তু হচ্ছে। রোজ দশ-বারোটা করে নাটকের শুটিং চলছে। স্বাভাবিক সময়ে তো আরও বেশি হতো। এখন অর্ধেকেরও কম হচ্ছে। স্বাভাবিক অবস্থা কবে আসবে এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। কিছুটা সময় তো লাগবেই।’
এবার লোকসানের পরিমাণ জানতে কথা হয় টেলিভিশন প্রোগ্রাম প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টেলিপ্যাব)-এর সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন দোদুলের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ক্ষতির পরিমাণ হুট করে বলা সম্ভব না। হিসাব করে বলতে হবে। আনুমানিকভাবে কোনো অ্যামাউন্ট বলা ঠিক না। এটা বিজনেসের বিষয়। হিসাব করে তবেই বলা উচিত। এছাড়া আমি কখনও অনুমান নির্ভর কথা বলি না।’
বিজ্ঞাপন
শিগগিরই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে মনে করছেন টেলিপ্যাবের এ নেতা। তার কথায়, ‘যেসব নাটক অনএয়ারে ছিল সেগুলোর শুটিং হচ্ছে। যেগুলো অনএয়ারে নেই সেসবের ক্ষেত্রে হয়তো সময় নেওয়া হচ্ছে। কেননা এখন নিউজের প্রতি দর্শকের আগ্রহ বেশি। অন্যকিছুর প্রতি না। তাছাড়া টেলিভিশন এখন এককভাবে ব্যবসাটা করতে পারে না। মূলধন তুলতে প্রচারের পর নিজেদের ইউটিউবে প্রকাশ করা হয়। আর যেহেতু এখন মানুষ নিউজে আগ্রহী সেকারণে ইউটিউবে দর্শক পাচ্ছে না। আশা করি শিগগিরই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। আর যেসব নাটকের প্রস্তুতি চলছিল সেগুলোর কাজ শুরু হচ্ছে। যেগুলো ইউটিউব চ্যানেল তারা এখন হয়তো দর্শক পাওয়া শুরু করবে।’
তার কথায়, ‘পরিস্থিতি অবশ্যই স্বাভাবিক হবে। কেননা অভিনেতা নির্মাতা প্রযোজকরা ঘরে বসে থাকবেন না। তাদের কাজ করতে হবে। এরইমধ্যে দেখছি স্বাভাবিকের মতোই প্রায় কাজ শুরু হয়েছে। চ্যানেলের অনএয়ারে থাকা নাটকগুলোর শুটিং নিয়মিত কাজ হচ্ছে। তাছাড়া কাজ কিন্তু একেবারে থেমে থাকেনি। যেগুলো ইনডোরের শুটিং করা যায় সেগুলো কিন্তু করা হয়েছে।’
আন্দোলন ও বন্যার ফলে নাট্যাঙ্গনে সাধিত ক্ষতি কেটে যাবে বলে আত্মবিশ্বাসী এ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘আমার মনে হয় আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব। কেননা এটা এমন কিছু না যে বছরের বছর পর বছর ধরে চলছে। আশা করি সবাই মিলে চেষ্টা করলে পুষিয়ে নেয়া সম্ভব। এছাড়া এই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের ফলাফল তো আমাদের জন্য ভালো। এখন সবাই কাজ করতে পারবে। আগে পারত না। বিশেষ করে বিটিভিতে কালো তালিকা ছিল। আমি নিজেও সে তালিকাভুক্ত ছিলাম। ১৯৯৬ সালে একটি নাটক করার পরই আমাকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। এরপর ২০০৮ থেকে আজ পর্যন্ত একবারের জন্যও বিটিভিতে অভিনয় কিংবা নাটক বানানো— কোনো কাজই করতে পারিনি। ওই জায়গা থেকে এখন সবার সুযোগ হবে কাজ করার। ফলে শিগগিরই আমরা ঘাটতি পুষিয়ে নেব।’
টেলিপ্যাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজু মুনতাসিরের মতে লোকসানের চেয়ে লাভ হয়েছে বেশি। তার কথায়, ‘ক্ষতির পরিমাণ বলা মুশকিল। আনুমানিক হিসাব দিতে গেলে বলতে হবে টেলিভিশন ও ডজিটাল মাধ্যম মিলিয়ে নাট্যাঙ্গনে ২০০ কোটির মতো লোকসান হয়েছে। তবে দুই মাসে লোকসানের চেয়ে লাভ হয়েছে বেশি বলে আমি মনে করি। অর্থনৈতিকভাবে লোকসান হলেও একজন নাগরিক হিসেবে বলব— রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা লাভবান হয়েছি। কেননা যে পরিস্থিতিতে বিগত সরকারের সময় ছিলাম সেখান থেকে বের হতে পেরেছি। দেশে এখন স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। এতদিন একটা আজব কারখানার মধ্যে ছিলাম। প্রত্যেক খাতে দলীয়করণ করা হয়েছিল।ওই জায়গা থেকে মুক্তি পেয়েছি।’
দোদুলের সুরে সাজু বলেন, ‘তবে অর্থনৈতিক ক্ষতি আমরা পুষিয়ে উঠতে পারব। এরইমধ্যে নাট্যাঙ্গনে কাজ শুরু হয়েছে। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই পুরোদমে কাজ চলবে। তবে লোকসানটা পুষিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগবে। তিন-চার মাসের মতো। কেননা ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি— নাটকের মৌসুম। ভালোবাসা দিবস, পহেলা বৈশাখ আছে। এছাড়া ঈদের কাজ শুরু হবে। সব মিলিয়ে আমরা একটা গতির মধ্যে চলে আসব।’
এসময় প্রান্তিক পর্যায়ের অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে টেলিপ্যাবের সাবেক এ নেতা বলেন, ‘ছোট একটা গোষ্ঠীর কিছুটা সমস্যা হয়েছে। তবে সেটা সাময়িক। কেননা আমরা কোভিডের সময় দুই বছরের ধাক্কা সামলে উঠতে পেরেছি। অতএব দুই মাসের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা আমাদের পক্ষে সম্ভব। আরেকটা বিষয় হচ্ছে ক্যারেক্টার আর্টিস্টদের অধিকাংশই সিরিয়ালে কাজ করেন। সিরিয়ালের শুটিং কিন্তু বন্ধ হয়নি। অল্প কিছুদিন বন্ধ ছিল। তারপরই উত্তরা পুবাইলসহ বিভিন্ন শুটিং হাউজে কাজ চলছে। মনে হয় না বেশি সমস্যা হবে।’