উন্মাদনার অপর নাম যেন ব্যান্ড সংগীত। তরুণ প্রজন্মকে প্রাণশক্তি যোগাতে এই ঘরানার গানের জুড়ি নেই। পৃথিবীর সর্বত্রই উঠতি বয়সী শ্রোতাদের নিকট ভীষণ জনপ্রিয় এই গান।
বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন ব্যান্ডে বুঁদ ছিলেন শ্রোতারা। তবে বর্তমানে বিশ্বের সকল দেশের তরুণ প্রজন্মকে এক ছাতার নিচে এনেছে দক্ষিণ কোরিয়ার ‘বুলেটপ্রুফ বয় স্কাউটস (বিটিএস) ব্যান্ড’। বিশ্বব্যাপী তুমুল জনপ্রিয় এই ব্যান্ডটি। বাংলদেশেও তাদের অসংখ্য অনুরাগী আছে।
বিজ্ঞাপন

কেন বিটিএস জনপ্রিয়
কেন বিটিএস এতটা জনপ্রিয়— এই প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে ঢাকা মেইল। কথা বলেছে দেশের জনপ্রিয় কয়েকজন ব্যান্ড সদস্যের সঙ্গে। তারা জানিয়েছেন নিজের মতামত।
জনপ্রিয় ব্যান্ড তারকা শাফিন আহমেদ মনে করেন, স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের কারণে বিটিএস ব্যান্ড জনপ্রিয়। তিনি বলেন, ‘অল্পবয়সী শ্রোতাদের আকর্ষণ করতে যা যা প্রয়োজন তার সবই তাদের গানে আছে। এ কারণে টিনএজরা পছন্দ করে ব্যান্ডটিকে। তাছাড়া ওদের মাঝে কিছু নতুনত্ব আছে। আপনি এই সাতজন ছেলের পারফরমেন্স, সাজসজ্জা, পোশাক দেখলেই সেটা বুঝবেন। এদের সবার চেহারা এক। প্রত্যেকেই কড়া মেকআপ নেন। পোশাকও একরকম। তো এই ব্যাপারগুলো একদমই নতুন। এই নতুনত্ব তাদের জনপ্রিয়তা অর্জনের আরেকটি কারণ।’
বিজ্ঞাপন
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে এই মুহূর্তে খুব বড়ভাবে প্রচলিত হয়ে গেছে ‘কে পপ’ অর্থাৎ কোরিয়ান পপ। ‘বিটিএস ব্যান্ড’ তারই একটি উদাহরণ। তবে দেখবেন, সারাবিশ্বে গান শোনার ক্ষেত্রে শ্রোতা-বিভক্তি আছে। সংগীতে অল্পবয়সী শ্রোতাও যেমন আছেন তেমনই বয়স্ক শ্রোতাও আছেন। বয়সভেদে এদের রুচিও আলাদা। সেই অর্থে ‘বিটিএসে’র গান স্কুল-কলেজপড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা বেশি শোনে। টিনএজদের কাছে ওরা ভীষন জনপ্রিয়।’
এ সময় ‘বিটিএস’কে একটি প্যাকেজ ব্যান্ড উল্লেখ করে এই তারকা বলেন, ‘আর একটা ব্যাপার হচ্ছে, তারা একটা প্যাকেজ ব্যান্ড। ঠিক একটি পণ্যের মতোই এদের প্রমোশন ও মার্কেটিং করা হয়। মঞ্চে যে তারা পারফর্ম করে সেটাও খুব পরিকল্পিত। একটা নির্দিষ্ট স্ট্র্যাটেজি নিয়ে চলেন তারা। তবে ব্যান্ডটি বিশ্বব্যাপী ভীষণ জনপ্রিয়—কথাটি মানতেই হবে। আমেরিকায় এমন ‘বয় ব্যান্ড’ আগেও ছিল। তবে কোরিয়ায় ওরাই নতুন।’
তবে ব্যান্ডটির মিউজিক ও গানের কথা গভীর কিছু বহন করে না বলে মনে করেন শাফিন আহমেদ। তাদের জনপ্রিয়তাকে সাময়িক উন্মাদনা আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের মিউজিক ও গানের লিরিক খুব ভারি কিছু না। তারা হালকা কথায়, হালকা মিউজিকে গান করে থাকেন। সেকারণে এই ব্যান্ডের মিউজিক নিয়ে গভীরভাবে ভাবার আসলে কিছু নেই। তারা কিছু বাজায় না। সব স্টুডিওতে তৈরি করা থাকে।’
অন্যদিকে বিটিএস ব্যান্ডকে স্যাটেলাইটের সঙ্গে তুলনা করে বংলাদেশের আরেক জনপ্রিয় ব্যান্ড তারকা মেহরীন বলেন, “আপনি যে ব্যান্ডের কথা বলছেন প্রযুক্তিগতভাবে তারা একটি ‘স্যাটেলাইট’। আর আমরা যেভাবে মিউজিক করি তাতে আমাদের ‘নৌকা’ বলা যায়। প্রথমে আমরা ‘নৌকা’ কেন সেটা বলে নেই। এ দেশের সংগীতাঙ্গনে আমরা যারা আছি তারা খুব আত্মকেন্দ্রিক। এখানে সংগীত মূলত আর্টিস্ট নির্ভর। যেমন আমরা ব্যান্ড আদলে চললেও এখানকার ব্যান্ডগুলো নাম নির্ভর হয়ে থাকে। এখানে ম্যানেজার বলেও কিছু নেই। তা ছাড়া গানের ক্ষেত্রে আমাদের কোনো পরিকল্পনা নেই। যে যার মতো করে নিজেদের গান প্রচার করে থাকি। এ কারণেই আমরা ‘নৌকা’। আমাদের এখানে হাতে গোনা কয়েকজন সচেতন আর্টিস্ট আছেন। তারা বাইরের দেশগুলো দেখে নিজেদের মতো করে একটি টিম করে তোলেন। আমাদের কাছে সেটা বিশাল কিছু মনে হলেও ওদের তুলনায় তা খুবই ক্ষুদ্র।’

‘বিটিএস’কে একটি পরিকল্পিত ব্যান্ড উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘সংগীতের প্রতি তাদের যে নিষ্ঠা, যে কায়দা-কানুন; তার সবই নির্ধারিত। গান ছাড়া এই ব্যান্ডের আর কোনো কাজ নেই। তারা একটা গান করার পর পৃথিবীর কোথায় কোথায় গানটি প্রকাশ করা হবে। কয় মিলিয়ন ভিউ হবে তা— নিয়ে কোনো চিন্তা করে না। এসব ভাবার আরও লোক আছেন। একটি আন্তর্জাতিক ব্যান্ডকে ঘিরে যে কর্মকাণ্ডগুলো চলে, তাদের নিয়ে এই কাজগুলো আরও প্রকটভাবে করা হয়। সেজন্য ব্যান্ডটি বর্তমানে ভীষণ জনপ্রিয়।’
ব্যান্ডটির জনপ্রিয়তার কারণ হিসেবে মেহরীন বলেন, ‘প্রথমে অডিওর কথা বলি। ওদের গানগুলো সবার নিকট ডিজিটালভাবে পৌঁছায় বলব না। আমি বলব ইলেক্ট্রনিক্যালি পৌঁছায়। অডিওগুলো হাই টেকনোলজি দিয়ে তৈরি করা। আর ভিডিওর ক্ষেত্রে দেখবেন, পারফরমেন্স, কোরিওগ্রাফি, কস্টিউম খুবই নিখুঁত। যারা পারফর্মার তাদেরও সমগ্র কোরিয়া থেকে ছেঁকে নেওয়া হয়েছে। মানুষকে আকর্ষণ করার একটি শিল্প ও বিজ্ঞান আছে। তার সবই তারা ব্যবহার করেন। আপনি সেই বিজ্ঞান ও শিল্প যদি একসঙ্গে প্রয়োগ করেন, তবে তো সবাই আকৃষ্ট হতে বাধ্য। এরপর মিডিয়া, প্রমোশনসহ অন্যান্য ব্যাপার তো আছেই।’
লালন ব্যান্ডের লিড ভোকাল সুমী কোরিয়ায় গিয়ে ‘বিটিএসে’র কথা প্রথম শোনেন। কোরিয়ান হয়েও সারাবিশ্বে ব্যান্ডটি জনপ্রিয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা একবার কোরিয়া সফরে গিয়েছিলাম। তখন এই ব্যান্ডটির কথা শুনি। কোরিয়ান হয়েও সারাবিশ্বে তুমুল জনপ্রিয় ওরা। ওদের এই জনপ্রিয়তা মূলত অল্পবয়সী শ্রোতাদের কাছে।’
এই জনপ্রিয়তার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “আমার যেটা মনে হয়, এখনকার ছেলে-মেয়েরা যা পছন্দ করে, ওদের যা ভালো লাগে— তার সবই ‘বিটিএসে’র মধ্যে আছে। মানে ব্যান্ডটা যেন ওদের মনের কথা বলে। ওরা যে ধরনের পৃথিবী প্রত্যাশা করে, ওদের কাছে যেন সেটাই পাচ্ছে। এ কারণেই বোধহয় এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ব্যান্ডটি।”

তবে ‘বিটিএসে’র এই জনপ্রিয়তার পেছনে সত্তর-আশির দশকের সংগীতের অবদান রয়েছে বলে মনে করেন সুমি। তিনি বলেন, ‘আমরা ৭০-৮০ দশকের যে মিউজিক শুনেছি, ওটাই কিন্তু আমাদের মূল ভিত্তি। সেটাকেই দিন দিন রিফাইন্ড, রি-রিফাইন্ড করা হচ্ছে। তারাও তাই করছেন। সেইসঙ্গে নতুন কিছু যোগ করেছেন। এ কারণেই বিশ্বব্যাপী একটা ওয়েভ তৈরি করতে পেরেছে ব্যান্ডটি।’
সংক্ষেপে বিটিএস
‘বিটিএস’ ২০১৩ সালে আত্মপ্রকাশ করে ব্যান্ডের সদস্য সংখ্যা সাতজন। তারা হলেন—আরএম, জিন, সুগা, জে-হোপ, ভি, জাংকুক ও জিমিন।
গত কয়েক বছর ধরে ‘কে-পপে’র জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, কারও কাজ ‘বিটিএসে’র জনপ্রিয়তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। তারা দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে সর্বাধিক বিক্রিত শিল্পী। বিটলসের পর তারাই দ্রুততম ব্যান্ড হয়ে ওঠে, যাদের অ্যালবাম যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ অবস্থান অর্জন করেছে। দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তারা এটি করেছে।

বিটিএস ২০২০ সালের আগস্টে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সর্বাধিক ইউটিউব ভিউয়ের রেকর্ড ভাঙে। তাদের প্রথম ইংরেজি গান ‘ডায়নামাইটে’র ভিডিও মাত্র একদিনে ১০১.১ মিলিয়ন মানুষ দেখেন। চলতি বছরের ২১ মে তারা আবার নিজেদের রেকর্ড ভেঙেছে। এ সময় তাদের দ্বিতীয় ইংরেজি গান ‘বাটারে’ ভিউ ছিল ১০৮.২ মিলিয়ন।
আরআর/আরএসও

