চাকরির পেছনে ঘুরেই শুধু জুতার তলি ক্ষয় হয় না। সেন্সর বোর্ড থেকে ছবি মুক্তির অনুমতি পেতেও যেন জুতার তলি ক্ষয় হয় পরিচালকদের! দেশের নির্মাতাদের জন্য সেন্সর বোর্ড যেন এমনই গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঝে মাঝেই সেখান থেকে সিনেমা আটকে দেওয়ার মাধ্যমে গুড়িয়ে দেওয়া হয় একজন নির্মাতার শ্রম ও স্বপ্নের যৌথ প্রচেষ্টা। বিগত সরকারের আমলে তা যেন আরও বেড়ে যায়। ফলে সেন্সরে বন্দি সিনেমার তালিকাটা দীর্ঘ হয়েছে।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দেশে বইছে পরিবর্তনের হাওয়া। রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে চলছে সংস্কার। সরব হয়েছেন চলচ্চিত্র নির্মাতারাও। তাদের ক্ষোভ সেন্সর বোর্ডের দিকে। এরইমধ্যে সেন্সর প্রথা তুলে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন বেশ কয়েকজন।
বিজ্ঞাপন
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় বর্ষীয়ান নির্মাতা কাজী হায়াতের সঙ্গে। সেন্সর প্রথা বাতিলের পক্ষে নাকি বিপক্ষে তিনি? এ বিষয়ে তার মতামতই বা কী? জানতে চাইলে নন্দিত এ নির্মাতা টান দেন সংবিধান ধরে।
ঢাকা মেইলকে কাজী হায়াৎ বলেন, ‘আমার মতামত, সংবিধানের ৩৯ ধারা আগে বাতিল করতে হবে। সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। তাহলেই সেন্সর করা লাগবে না। কেননা আপনাকে কতটুকু বাক স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে ৩৯ ধারায় সেটা লেখা আছে। ওই লেখার উপর ভিত্তি করেই সেন্সর বোর্ডের নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। আমি এর পক্ষে বিপক্ষে মত দেওয়ার কেউ না। সেন্সর বোর্ড না থাকলে ভালো। আর থাকুক বা না থাকুক আমার এতে কিছু আসে যায় না।’
কাজী হায়াতের কথানুযায়ী সংবিধান খুলে দেখা যায় ৩৯ ধারায় লেখা আছে, (১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হইল (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংগঠনের প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে
(ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং
(খ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হইল।
কাজী হায়াৎ ফের জোর দিয়ে বলেন, ‘এই বাক স্বাধীনতা অনুযায়ী সেন্সর বোর্ড তৈরি হয়েছে। অতএব আমার আপনার কিছুই বলার নেই। ৩৯ ধারায় যদি কেউ পরিবর্তন আনতে পারে তাহলে হয়তো সেন্সর বোর্ডে কিছু পরিবর্তন আসবে।’
কাজী হায়াতের অসংখ্য ছবি সেন্সর বোর্ডের রোষানলে পড়েছে। ফলে তারও রয়েছে ভোগান্তির গল্প। তিনি মনে করেন সেন্সর বোর্ড দ্বারা তিনি যতটা ভোগান্তির শিকার হয়েছেন কোনো নির্মাতাই ততটা ভোগেননি।
তার কথায়, ‘‘সেন্সর বোর্ড আমাকে যতটা ভুগিয়েছে কোনো পরিচালককে এত ভোগান্তি ভোগায়নি। ৫২টি ছবি বানিয়েছি। সেন্সর বোর্ডের মেম্বাররা ২৬ টি ছবিকেই প্রদর্শনীর অযোগ্য বলেছেন। নিষিদ্ধ করেছেন। অনেক চড়াই-উৎড়াই পেরোতে হয়েছে। ‘আম্মাজানে’র মতো ছবি সেন্সরে ৬ মাস আটকে রাখা হয়েছিল। কেন আটকে রাখল আমি কিছুই বুঝলাম না। তবে একজন মেম্বার নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলেন। আমি তার নাম প্রকাশ করতে চাইনা। অনেক তদবির করে যখন ছবিটা মুক্তির অনুমতি নেয়া হলো তখন সেন্সর বোর্ডের এক মেম্বার আমি তার নাম প্রকাশ করছি না। তিনি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলেন, এই ছবি মুক্তি পেলে দেশে দাঙ্গা শুরু হবে। কী বুঝে উনি বলেছিলেন আমি অদ্যাবধি বুঝি নাই। উনারা বুদ্ধিজীবি তো ওনারা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি।’’
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘শনিবার বিকেল’, ‘রায়হান রাফীর অমীমাংসিত’ সিনেমা দুটি বন্দি সেন্সর বোর্ডে। এছাড়া আটকে আছে এনামুল করিম নির্ঝরের ‘নমুনা’, নজরুল ইসলামের ‘রানা প্লাজা’, অনন্য মামুনের ‘মেকআপ’, অং রাখাইনের ‘মং থেংগারি (আমার বাইসাইকেল)’, সাজ্জাদ খানের ‘কাঠগোলাপ’সহ আরও কিছু সিনেমা।