চলচ্চিত্র শুধু বিনোদনের খোরাক নয়, প্রতিবাদের ভাষাও। ঝলমলে কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেটারই যেন প্রমাণ মিলছে প্রতিমুহূর্তে। ১৭ মে এই উৎসবের ৭৫তম আসরের উদ্বোধন হয়েছে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির ভিডিও ভাষণের মাধ্যমে। তারপর থেকে কোনো না কোনোভাবে উৎসবে প্রতিদিনই উচ্চারিত হচ্ছে ইউক্রেনের নাম। শুক্রবার (২০ মে) রেড কার্পেটে এক নারী ইউক্রেন যুদ্ধে নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ জানালে বিষয়টি আরও বেশি আলোচনায় আসে। ওই নারী গায়ে রঙ ছিটিয়ে ইউক্রেনের পতাকা এঁকে রক্ত রঙে লিখেছিলেন ‘আমাদের ধর্ষণ বন্ধ করুন।’
শুধু আগ্রাসন নয়, যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের মানুষের অনিশ্চিত যাত্রা নিয়েও প্রতিবাদ চলেছে। কানের পালে দে ফেস্টিভাল ভবনে বেশ কয়েকজন ইউক্রেনীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রযোজকের সাথে দেখা হয়েছে। যারা নিজ দেশের দুরাবস্থার কথা বিশ্ববাসীর কাছে জানাতে এখানে এসেছেন। তাদেরই একজন রোমান। ইউক্রেনের তরুণ সিনেমা নির্মাতা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে হারিয়েছেন পরিবার, হারিয়েছেন ঠিকানা। তার দেশ আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে এই বিশ্বাস নিয়ে দিন কাটান। রোমান জানালেন, রাশিয়ান সেনাদের ভয়াবহ নির্যাতনের গল্প। কান চলচ্চিত্র উৎসবে নিজের দেশের জন্য ক্যাম্পেইন চালিয়ে যাচ্ছেন রোমান। স্বপ্ন দেখেন, একদিন নিজ দেশে গিয়ে আবার সিনেমা বানানো শুরু করতে পারবেন। আমাকে বললেন, আমি যেন তার দেশের জন্য প্রার্থনা করি।
বিজ্ঞাপন
কান চলচ্চিত্র উৎসব শুরুর আগেই এর কর্তৃপক্ষ ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রতিবাদ জানিয়েছিল। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরই সে দেশের পরিচালক ও প্রযোজকরা বিশ্ববাসীর কাছে যুদ্ধ সমর্থনকারী রাশিয়ানদের বয়কটের আহ্বান জানিয়েছিলেন। এরপর মার্চে কান কর্তৃপক্ষ একটি বিবৃতিতে বলেছিল, ৭৫তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে রাশিয়ান কোনো কর্মকর্তাকে স্বাগত জানানো হবে না এবং রাশিয়ার সরকারের সাথে যুক্ত কারো উপস্থিতিও গ্রহণ করা হবে না।
তবে চলমান উৎসবের মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে রাশিয়ান পরিচালক কিরিল সেরেব্রেনিকভ-এর ছবি রয়েছে। যার নাম ‘চাইকস্কি’স ওয়াইফ’। বিষয়টি নিয়ে কান কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশ্ন করা হলে তারা জানান, ‘খুব সীমিতসংখ্যক রাশিয়ান মিডিয়া আউটলেট অনুমোদন দেওয়া হয়েছে যারা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। তবে এই বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি যে, রাশিয়ার কোনো সরকারি গণমাধ্যম এই অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে ইমেইল পাঠিয়েছিল কি না।
এবার প্রতিযোগিতা বিভাগে ইউক্রেনীয় পরিচালকদের দুটি চলচ্চিত্র রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে মাকসিম নাকোনেচনির ‘বাটারফ্লাই ভিশন’ এবং সের্গেই লোজনিতসার ‘ দ্য ন্যাচারাল হিসটরি অফ ডেস্ট্রাকশান’। তবে এই ছবিগুলো পুরস্কার পেলেও তা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে। কারণ ইউক্রেনীয় ফিল্ম একাডেমি লোজনিতসাকে গত মার্চে বহিষ্কার করেছিল। কারণ তিনি রাশিয়ান সিনেমা বয়কটের আহ্বানকে সমর্থন করেননি। মার্চে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলেছিলেন, যখন আমি রাশিয়ান চলচ্চিত্র বয়কটের আহ্বান শুনি, তখন আমি রাশিয়ান বন্ধুদের কথা ভাবি। আমরা লোকদের পাসপোর্ট দিয়ে বিচার করতে পারি না। কারণ তারা এই যুদ্ধের শিকার, ঠিক আমাদের মতো।
বিজ্ঞাপন
এদিকে নিজের সিনেমার কৌশলীদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে হাজির হয়েছিলেন কিরিল সেরেব্রেনিকভ। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই তিনি ইউক্রেনের ওপর রুশ আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়েছেন তিনি।
৭৫তম কান উৎসবের মূল প্রতিযোগিতা শাখায় নির্বাচিত ২১টি চলচ্চিত্রের তালিকায় রাশিয়ার একমাত্র ছবি ‘চাইকস্কি’স ওয়াইফ’। গত ১৮ মে বিকাল ৩টায় পালে দে ফেস্টিভাল ভবনের সাল বাজিন প্রেক্ষাগৃহে এবং বিকাল ৩টা ৩০ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় রাত ৭টা ৩০ মিনিট) গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়েরে দেখানো হয় এটি। একই প্রেক্ষাগৃহে বৃহস্পতিবার (১৯ মে) সকাল ৮টা ৩০ মিনিট ও বিকাল ৩টায় এবং সাল আনিয়েস ভারদা প্রেক্ষাগৃহে বিকাল ৩টা ও সন্ধ্যা ৭টায় এর আরও চারটি প্রদর্শনী ছিল। সব কটিতে ব্যাজধারী ও আমন্ত্রিত দর্শকদের ভিড় দেখা গেছে।
কিরিল সেরেব্রেনিকভ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সমালোচক হিসেবে পরিচিত। সংবাদ সম্মেলনে তার মন্তব্য, ‘সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিমনা মানুষেরা ইউক্রেনে যুদ্ধের অবসানে বড় সহায়ক হতে পারে। আমাদের বুঝতে হবে, যুদ্ধ শেষ হলেই কেবল আমরা শান্তিতে থাকতে পারবো। যুদ্ধ মানুষ হত্যা করে। শিল্প বরাবরই তুলে ধরে মানুষের জীবন কতটা অরক্ষিত এবং প্রতিটি প্রাণ বাঁচানো কতটা গুরুত্বপূর্ণ।’
কানের আগের আসরগুলোর মধ্যে কিরিল সেরেব্রেনিকভের ‘লেটো’ ২০১৮ সালে এবং ‘পেত্রোভ'স ফ্লু’’ গত বছর স্বর্ণপামের জন্য মনোনীত হয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা থাকায় তিনি কানসৈকতে আসতে পারেননি। ২০২০ সালে মস্কোর গোগোল সেন্টার থিয়েটারে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন তিনি। মামলাটি আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ধারণা করা হয়, পুতিন এবং তার সরকারের বিরোধিতা করা রাশিয়ার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে।
মস্কোর একটি আদালত তিন বছরের সাজা স্থগিত করলে ছয় সপ্তাহ আগে রাশিয়া ছাড়েন কিরিল সেরেব্রেনিকভ। তিনি এখন জার্মানির বার্লিনে থাকছেন। রাশিয়া ছাড়ার আগে পুতিনবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেন তিনি।
‘চাইকস্কি’স ওয়াইফ’ ছবির গল্প ঊনিশ শতকের রুশ সুরস্রষ্টা পাইওত্র চাইকস্কির বিয়েকে কেন্দ্র করে। তার আত্মজীবনীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এটি। বিয়ে করার পর এই শিল্পীর জীবন আমূল বদলে যায়। কারণ তিনি পুরুষদের সঙ্গ পছন্দ করতেন। কিন্তু রাশিয়ায় সমকামীদের সামাজিক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়। এ কারণে সমকামিতাকে আড়াল করতে বিয়ে করে গুজবে জল ঢেলে মানসিক স্বস্তি খুঁজে নিয়েছিলেন তিনি। একসময় স্ত্রীর কাছ থেকে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন চাইকস্কি। এ কারণে ধার্মিক ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তরুণী আন্তোনিনা মিলিউকোভা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত তিনি অবসাদ ঘিরে ধরে তাকে।
ছবিটিতে চাইকস্কির ভূমিকায় ওডিন বাইরন এবং আন্তোনিনা চরিত্রে অভিনয় করেছেন আলিওনা মিখাইলোভা। সংবাদ সম্মেলনে তারাও এসেছিলেন।
ছবিটি কি রাজনৈতিক? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে কিরিল সেরেব্রেনিকভ বলেন, সব শিল্পই এক ধরনের রাজনীতি, বিশেষ করে বর্তমান সময়ে। আমাদের রাজনৈতিক বক্তব্য শিল্প, স্বাধীনতা এবং অবশ্যই মানুষের স্বাভাবিক বেঁচে থাকার হুমকিকে তুলে ধরে।
রুশ হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ইউক্রেনের জনগণের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে কান উৎসব আয়োজকরা এবার পুতিন সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফিল্ম প্রফেশনালদের নিষিদ্ধ করেছে। একইসঙ্গে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানান তারা। কিয়েভ থেকে লাইভ ভিডিওতে তিনি যুদ্ধ নিয়ে সরব হওয়ার ডাক দিয়েছেন সারাবিশ্বকে। তারকা সমাবেশে এমন উদ্যোগ নেওয়ায় আয়োজকদের প্রশংসা করেছেন কিরিল সেরেব্রেনিকভ।
ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার অনেক সাংবাদিক এবারের কান উৎসবে অংশগ্রহণের সুযোগ পাচ্ছেন না। তাদের কাউকে অ্যাক্রেডিটেশন দেয়নি আয়োজকরা। কানের বাণিজ্যিক শাখা মার্শে দ্যু ফিল্মে ইউক্রেনের পেশাদার চলচ্চিত্রকর্মীদের কান ভ্রমণ ও হোটেল ভাড়া মেটাতে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে ইউরোপিয়ান কমিশন।
একেবি/জেবি