আজ বৃহস্পতিবার চাঁদ তারাদের কাছে চলে গেছেন ‘চাঁদ তারা সূর্য নও তুমি’র গায়ক শাফিন আহমেদ। ‘ফিরিয়ে দাও’ কণ্ঠে তুলে আর ফিরবেন না মঞ্চে। দীর্ঘ সংগীত ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় শাফিনের কেটেছে মাইলসের সঙ্গে। তার কণ্ঠেই ডানা মেলেছে ব্যান্ডটির অধিকাংশ গান। পেয়েছে হিমালয়সম জনপ্রিয়তা।
মাইলসের জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘জাতীয় সংগীতের দ্বিতীয় লাইন’। যেখানে প্রিয়তমাকে ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে জাতীয় সংগীতের দ্বিতীয় লাইন (আমি তোমায় ভালোবাসি) উৎসর্গ করার মাধ্যমে। এ কারণে গানটি এখনও আলাদাভাবে ভাবায় শ্রোতাদের। এ গানও শ্রোতাদের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে শাফিনের কন্ঠে ভর করে। গানটির কথা লিখেছেন গীতিকবি রনিম রহমান।
বিজ্ঞাপন
শাফিনকে হারানোর দিনে ঢাকা মেইলকে শোকে নিমজ্জিত রনিম শোনালেন ‘জাতীয় সংগীতের দ্বিতীয় লাইন’ গানটির গল্প। রনিম বলেন, ‘‘২০০৪ সালের ঘটনা। মাইলস তখন ‘প্রতিধ্বনি’ অ্যালবাম নিয়ে কাজ করছে। শাফিন ভাই আমাকে অ্যালবামটির জন্য গান লিখতে বলেন। ততদিনে ব্যতিক্রমী কথার গানের গীতিকার হিসেবে সংগীতাঙ্গনে পরিচিতি গড়ে উঠেছে আমার। এর আগে জেমস ভাইয়ের জন্য লিখেছিলাম ‘দুঃখওয়ালা’, ‘দুঃখবার্ষিকী’। বিপ্লব ভাইয়ের জন্য ‘প্রেম ডট কম’। চাইছিলাম মাইলসকেও এমন একটি গান দিতে। সেকারণে একটু দেরি হচ্ছিল। পরে ‘জাতীয় সংগীতের দ্বিতীয় লাইন’ গানটি লিখে শাফিন ভাইকে দেই।’’
ভিন্নভাবে প্রেমিকাকে মনের কথা বলার গানটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতারা লুফে নিলেও শাফিন আহমেদ দুই-দুইবার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বিষয়টি উল্লেখ করে রনিম বলেন, ‘গানটি লিখে দেওয়ার পর দুইবার ফিরিয়ে দেন শাফিন ভাই। তৃতীয় বার যখন ফেরত দিলেন তখন ওনার প্র্যাকটিস প্যাডে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ভাই এটা ফেরত দিচ্ছেন কেন। তিনি বললেন, না, এই গানটা না। সেসময় তাকে বোঝালাম জাতীয় সংগীতের দ্বিতীয় লাইন হচ্ছে আমি তোমাকে ভালোবাসি। তখন বুঝলেন। এর আগে দুই-তিনদিন হয়তো কোনো কারণে মনোযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলেন। নইলে ওনার মতো একজন গায়ক বিষয়টি বুঝবেন না তা তো না। শাফিন ভাই তখন বললেন, বাহ, দারুণ লিখেছ তো! একদম ব্যতিক্রম। কীভাবে লিখলে এটা! আমি বললাম, ভাই সবাই তো আমি তোমাকে ভালোবাসি লেখে। কিন্তু আমি একই কথা বলব তবে ভিন্নভাবে। সেকারণেই এভাবে লিখেছি। তিনি এটা লুফে নেন। বললেন, এবার মাইলসের টার্গেট সং এটা (জাতীয় সংগীতের দ্বিতীয় লাইন)।’
সুর করতেও বেশি সময় নেননি শাফিন। সেদিন রাতেই সুরে বসিয়েছিলেন জাতীয় সংগীতের দ্বিতীয় লাইনে। পরদিন বিকেলে মোবাইল ফোনে শুনিয়েছিলেন রনিমকে। সে সুর মুগ্ধ করেছিল গীতিকবিকেও।
রনিম বলেন, ‘‘প্রতিধ্বনি’ অ্যালবাম বাজারে আসে ২০০৫-৬ সালের দিকে। সেসময় বিটিভির আনন্দমেলায়ও গানটি পরিবেশন করে মাইলস। এরপরই দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। তুমুল জনপ্রিয়তা পায় গানটি। অ্যালবামটিতে ‘মান চায়’, ‘সাত দিনের তুমি’, ‘কেঁপে ওঠে মন’ শিরোনামের আরও তিনটি গান ছিল আমার।’’
বিজ্ঞাপন
শুধু শাফিন আহমেদ নন, মাইলসের অন্য সদস্যরাও জাতীয় সংগীতের দ্বিতীয় লাইনের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। রনিমের কথায়, ‘‘মানাম ভাই বলেছিলেন, তুমি তো দারুণ লিখেছ। শাফিন ভীষণ খুশি হয়েছে। ‘জাতীয় সংগীতের দ্বিতীয় লাইন’ বের হওয়ার পর দেশের কয়েকজন বড় বড় ব্যান্ড তারকা বলেছিলেন গানটি তাদের দেইনি কেন। অনুযোগের সুরে বলেছিলেন, তুমি সব ভালো গান শাফিন ভাইকে দিয়ে দাও।’’
গানটির জনপ্রিয়তার উদাহরণ দিতে রনিম একটি টিভি লাইভ অনুষ্ঠানের ঘটনা তুলে ধরেন। সে অনুষ্ঠানে অতিথির আসনে ছিল মাইলস। উপস্থাপিকা ‘জাতীয় সংগীতের দ্বিতীয় লাইন’ গানটির অনুরোধ করেন। কিন্তু ততক্ষণে সবকটা গান করেছে মাইলস। তাই গানটি অসম্মতি জানায়। কিন্তু এত অনুরোধ আসতে থাকে যে, বাড়তি সময় নিয়ে মাইলস বাধ্য হয়েছিল গানটি করতে।’
শাফিনের হাত ধরে কবি থেকে গীতিকবি হয়েছেন রনিম। দেশের বড় বড় ব্যান্ড তারকার কণ্ঠে ডানা মেলেছেন তার গীতিকবিতা। তবে শাফিনের সঙ্গে সম্পর্কের জায়গাটি ছিল তার আত্মিক। গীতিকবি ও গায়কের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। রনিমের ভাষায়, ‘শাফিন ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল পারিবারিক। বড় ভাই-ছোট ভাইয়ের মতো। মনমালিন্য হতো আবার মিলে যেতাম। উনি ছিলেন স্পষ্টবাদী। তবে ভেতরে ভেতরে ছিলেন খুব নরম ও সরল।’