রোববার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

আমি চাই না আমার জন্য মেয়ের জীবনটা নষ্ট হোক: আকবরের স্ত্রী

রাফিউজ্জামান রাফি
প্রকাশিত: ২৬ মে ২০২৪, ০২:৪৪ পিএম

শেয়ার করুন:

আমি চাই না আমার জন্য মেয়ের জীবনটা নষ্ট হোক: আকবরের স্ত্রী
রিকশাওয়ালা থেকে সংগীতশিল্পী হয়ে উঠেছিলেন আকবর আলী গাজী ওরফে আকবর। জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে গান পরিবেশনের মাধ্যমে ভাগ্যের বদল ঘটেছিল। মুহূর্তেই পেয়েছিলেন তারকাখ্যাতি।  

আকবরের চলার পথ বেশিদিন মসৃণ থাকেনি। রোগ ব্যাধি জড়িয়ে ধরে। পেয়ে বসে অভাব অনটন। শুন্য থেকে উঠে আসা গায়কের নিঃস্ব হতে সময় লাগেনি। বছর দেড়েক হলো পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন তিনি। পরিবারের জন্য রেখে যেতে পারেননি তেমন কিছু। 


বিজ্ঞাপন


333016433_3275512416045337_4350588693995453967_nজীবদ্দশায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিকিৎসার জন্য ২০ লাখ টাকা অনুদান দেন আকবরকে। ওই অর্থ অবলম্বন করেই দিন চলছে তার স্ত্রী ও মেয়ের। এরকমই জানালেন আকবরের স্ত্রী কানিজ ফাতেমা। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘ব্যাংকে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া যে সঞ্চয়পত্র আছে ওটা দিয়েই কোনোরকম চলে যায়।’

কিন্তু ২০ লাখের বিপরীতে তিন মাস অন্তর যে টাকা পান তাতে পরের তিন মাস জীবনধারণ কষ্টকর হয়ে পড়ে না? উত্তরে আকবরপত্নী বলেন, ‘কিছু করার নেই। ওটা দিয়েই কোনোরকম চলতে হয়। মেয়েকে রেখে চাকরিও করতে পারছি না। ওর পড়াশোনা, কোচিং আছে, গান শেখে। সব মিলিয়ে কিছু করা সম্ভব হয়ে উঠছে না।’ 
 
আকবরের মৃত্যুর পর মেয়ে অথৈর স্কুলের সমস্ত খরচ মওকুফ করে দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। সুযোগটি কলেজ পর্যন্ত থাকবে বলে জানিয়েছিলেন তারা। তবে নতুন বছরে মত বদলেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। এতদিন বিনা বেতনে পড়লেও এখন অর্ধেক বেতন দিতে হচ্ছে তাকে। আকবরের স্ত্রী বলেন, ‘স্কুলের সুযোগটা এখন আর নেই। আগে পুরোপুরি ফ্রি থাকলেও এখন বেতনের অর্ধেক দিতে হয়। কলেজ পর্যন্ত দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু এবার কিছু সমস্যার কারণে ফিফটি পার্সেন্ট টাকা দিতে হচ্ছে। তারা বলেছেন, এবার গরীব কোটাতে অনেক বাচ্চা ভর্তি হয়েছে। সে কারণেই ফিফটি পার্সেন্ট দিতে হবে। এতে চাপ বেড়েছে। আগে চিন্তামুক্ত ছিলাম। কিন্তু এখন ভাবতে হচ্ছে। মেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে উঠেছে। ওকে কোচিংয়ে দিতে হয়েছে। পড়াশুনা বাবদ মাসে ৬ থেকে ৬৫০০ টাকার মতো খরচ। সব মিলিয়ে সমস্যা-ই হয়।’ 

436495153_3915273975460923_7329023827926813926_n
অথৈ গান শেখে বিশিষ্ট নজরুল সংগীত শিল্পী এবং নজরুল গবেষক সুজিত মোস্তফার কাছে। আকবর চলে যাওয়ার পর থেকে বিনা বেতনে গান শেখাচ্ছেন তিনি। স্কুল মত বদলালেও তিনি আগের অবস্থানেই আছেন উল্লেখ করে কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘বিনা পারিশ্রমিকেই গান শেখাচ্ছেন। তিনি বলেছেন আকবর ওকে আমার হাতে দিয়ে গেছে। ওর দায়িত্ব সব আমার।’ 
 
কণ্ঠ দিয়ে আকবর জয় করেছিলেন সংগীতপ্রেমীদের মনের জমি। দেশ-বিদেশে তার শুভাকাঙ্ক্ষীর অভাব নেই। চিকিৎসা চলাকালীন খোঁজ নিতেন তারা। এখনও কি খবর নেন— জানতে চাইলে কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘এখন আমি-ই কারও  সাথে যোগাযোগ করি না। মানুষ এত খারাপ কথা আমাকে নিয়ে বলেছে যে ভাবতেই লজ্জা লাগে। প্রধানমন্ত্রী টাকা দিয়েছেন। সে টাকা নাকি দুই দিনেই খেয়ে ফেলেছি। স্বামীর অসুস্থতা নিয়ে নাকি ব্যবসা করেছি। আসলে যার ঘরে কিডনি ও ক্যানসারের রোগী থাকে এই কষ্টটা সেই বোঝে। সেই ২০১৫ থেকে এই যন্ত্রণা ভোগ করছি। সেটা কেউ বোঝে না। এ কারণেই নিজেকে সবার থেকে লুকিয়ে রাখি।’ 
 
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকবরপত্নী বলেন, ‘আমার একটা জীবন আছে। মেয়েকেও মানুষ কত কথা জিজ্ঞেস করে। আর যার জন্য এত কিছু সে তো নেই। আমাদের মা মেয়েকে কোনোরকম আল্লাহ তাআলা চালিয়ে নিয়ে যান।’

315567748_3503386633280951_2897521910842967894_n
যোগাযোগ যতটুকু করার হানিফ সংকেত ও মনোয়ার হোসেন ডিপজলের সঙ্গে করেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘স্যারের (হানিফ সংকেত) সঙ্গে আর বসের (ডিপজল) সঙ্গে যোগাযোগ আছে। ঈদের আগেও অফিসে যে দেখা করে এসেছি। বেশি যোগাযোগ করি না। সেজন্য স্যার বকেন। মেয়ের পড়াশুনার কথা জানতে চান। উনি আমার মেয়েটাকে অনেক ভালোবাসেন। বসের সঙ্গেও অনেকদিন ধরে যোগাযোগ করি না। অথৈ স্কুলে ভর্তির সময় যোগাযোগ করেছিলাম। সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। প্রয়োজনে ফোন দিলে না করেন না। কিন্তু আমি দিই না। কারণ, এই মানুষটাকে তো কম বিরক্ত করিনি। খুব বিপদে না পড়লে ফোন দেই না। তবে উনি বলেছেন, যখনই সমস্যায় পড়বি আমাকে ফোন দিবি। কখনও মনে করবি না যে আকবর মরে গেছে বলে আমার সাথে তোদের সম্পর্ক শেষ। মেয়েটা ছোট। ওর দায়িত্ব আমাদের।’ 
 
এদিকে আকবরকে বিয়ে করায় কানিজ ফাতেমার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে তার পরিবার। আর কখনও খোঁজ নেয়নি তারা। আকবর চলে যাওয়ার পর কি খোঁজ নিয়েছে? জবাবে অভিমানী কানিজ বলেন, ‘আমি আসলে এ বিষয় নিয়ে কিছু বলতে চাচ্ছি না। বোঝা যায় সম্পর্কের সুতা আর জোড়া লাগেনি।’ 


বিজ্ঞাপন


443696232_3912719345716386_3806130082802795929_n
নিজের পরিবারের ওপর অভিমানের পাশাপাশি ক্ষোভ জমিয়ে রেখেছেন স্বামীর পরিবারের ওপর। তিনি বলেন, ‘আমি নিজেই আকবরের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করি না। তারা আজেবাজে কথা বলে। কিছুদিন আগে তাদের একজন সাক্ষাৎকারে বলেছেন অনন্ত জলিল নাকি ২০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। তিনি যদি ২০ লাখ টাকা দিতেন আপনারা সাংবাদিকরা জানতেন না? আমার স্বামী যখন মারা গেছেন আমার ঘুমানোরও জায়গা ছিল না। সম্প্রতি তারা বলে বেড়াচ্ছে আমি নাকি বিয়ে করেছি। বিয়ে আমাকে অনেকেই করতে বলেন। মেয়ের স্কুল থেকেও বলে। কিন্তু আমি বলেছি আমার সময় দরকার। আমি চাই না আমার মেয়ের জীবনটা আমার জন্য নষ্ট হোক।’
 
আকবরের পরিবার নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই কানিজ ফাতেমার। তিনি বলেন, ‘সেদিন এক জায়গায় বলেছে আমার কাছে ৪০ লাখ টাকা আছে। আবার বলে অনেক কিছু রেখে গেছে। রেখেই যদি যেত ঢাকা শহরে মেয়েকে নিয়ে দু’দিন না খেয়ে থাকতে হতো না। সবার সাহায্য নিয়ে তার চিকিৎসা করতে হতো না। আপনারা জানেন আমার স্বামী আমাকে কোন অবস্থায় রেখে গেছে। তার চিকিৎসায় কত টাকা খরচ হয়েছে। একটা মানুষ লাইফ সাপোর্টে থাকলে কত টাকা খরচ হয় এটা বোঝে না। ওদের মতো মানুষের বোঝার ক্ষমতা নেই।’ 
 
মেয়েকে বড় করে যেতে পারেননি আকবর। সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন কানিজ ফাতেমা। তিনি বলেন, ‘আমি তাকে (আকবরকে) কথা দিয়েছি মেয়েটাকে মানুষ করব। আমার মেয়েকে দেখে মানুষ বলবে এটা আকবরের মেয়ে।’ 

443696232_3912719345716386_3806130082802795929_n
আকবরের পরিবার পরিজনের সঙ্গে আলাদা হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘আমি দেখেছি মানুষটা কত সম্মানের ছিলেন। এখনও অনেকেই ফোন করে কান্না করে। আমি চাই না তাকে নিয়ে কেউ বাজে কথা বলুক। চাই তার সম্মান অক্ষুন্ন থাকুক। এ কারণেই আমি ওর ফ্যামিলি থেকে আমার মেয়েটাকে নিয়ে একদম একা হয়ে গেছি।’
 
মেয়েকে নিয়ে বলেন, ‘অথৈর একটাই দুঃখ। বন্ধুরা যখন বাবার কথা বলে। ও বলে, ‘আম্মু আমি আর আব্বুকে নিয়ে কখনও কিছু বলতে পারব না।’

238904869_2970334143293666_353094048320757305_n
আকবরের স্ত্রীর কথানুযায়ী অনেকেই তাকে নতুন করে জীবন শুরু করতে বলেন। বিয়ে করতে বলেন। তার কী মত— জানতে চাইলে বলেন, ‘এটা আল্লাহর হাতে। কিন্তু আমি আকবরের স্ত্রী— পরিচয়টা আমার কাছে অনেক সম্মানের। এখনও রাস্তায় অনেকে বলেন, আপনি আকবর ভাইয়ের স্ত্রী না। খুব ভালো লাগে। কিন্তু আল্লাহ কার জীবনে কখন কী লিখে রেখেছেন সেটা বলা যায় না। তবে আমি আমি চাই মেয়েটাকে নিয়েই আকবরের স্ত্রী হিসেবে বেঁচে থাকতে।’
 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর