প্রকাশের পর শ্রোতারা লুফে নিয়েছে কোক স্টুডিও বাংলার তৃতীয় সিজনের দ্বিতীয় গান ‘মা লো মা’। ছাদ পেটানোর স্মৃতি এবং লোকগান ও র্যাপের মিশেলে এ পরিবেশনের ছন্দে নেটিজেনরা যখন দুলছেন তখন হঠাৎ ছন্দ পতন ঘটাল বেরসিক এক অভিযোগ। তবে সেটি গুরুতর।
গানটির গীতিকারের নাম নিয়ে মিথ্যাচার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে। কোক স্টুডিও বাংলা গানটির গীতিকারের ঘরে খালেক দেওয়ানের নাম উল্লেখ করলেও দাবি করা হচ্ছে তথ্যটি মিথ্যা। গানটি নেত্রকোনার বাউল রশিদ উদ্দিনের লেখা।
বিজ্ঞাপন
বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ নেত্রকোণার সংস্কৃতিকর্মীরা। তারা সোমবার (৬ মে) সামাজিক-সাংস্কৃতিক-সাহিত্য সংগঠনসমূহ ও সম্মিলিত নাগরিক সমাজের ব্যানারে কোক স্টুডিও বাংলার বিরুদ্ধে অনৈতিকভাবে গানটি বাউল আব্দুল খালেক দেওয়ানের লেখা বলে প্রচারের অভিযোগ এনে মানবন্ধন করেছেন স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মীরা।
এবার বিষয়টি নিয় মুখ খুললেন বাউল সাধক খালেক দেওয়ানের নাতি ও সংগীতশিল্পী সাগর দেওয়ান। অভিযোগকারীদের নিয়ে ঢাকা মেইলকে সাগর বলেন, ‘যারা এই দাবি করছেন আমরা তাদের আহ্বান জানাচ্ছি। তাদের কাছে যদি কোনো প্রমাণ থাকে সেগুলো উপস্থাপন করতে। গানটি যখন রেকর্ড করা হচ্ছিল তখনও আহ্বান জানিয়েছি। বারী ভাইয়ের কণ্ঠে গানটি আমি শুনিনি। যখন কোক স্টুডিও বাংলায় গানটি রেকর্ড করা হচ্ছিল তখন গানটি শুনেছি। বারী ভাইও (সংগীতশিল্পী বারী সিদ্দিকী) রশিদ উদ্দিনের নামে গানটি গেয়েছেন। কেন গেয়েছেন আমি জানি না। এর আগে পরে বাউল মিরাশ উদ্দিনের অনেক গান বারী ভাই রশিদ উদ্দিনের নামে ঢাকা শহরে ঢুকিয়েছেন। হয়তো গানের ইতিহাস সম্পর্কে জানতেন না। না জেনে করতে পারেন।’
এরপর পূর্বপুরুষ সম্পর্কে তরুণ এই গায়ক বলেন, ‘শুধু আমরা কেন আমাদের মা-বাবা, গ্রাম বাংলার যারা আছেন, মুরুব্বিরা যারা আছেন তাদের জিজ্ঞেস করলে সবাই এক বাক্যে বলবেন এটা খালেক দেওয়ানের গান। জন্মের পর থেকেই এই গান খালেক দেওয়ানের নামে শুনে আসছি। তাকে চেনেন না এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তিনি তো পালাকার ছিলেন। মঞ্চে শতাধিকবার এই গানটি গেয়েছেন। ৫০-৬০ বছর আগের কথা বলছি। এছাড়া ১৯৬০ সালে হিজ ভয়েস মাস্টার কোম্পানিতে এই গান রেকর্ড করা হয়েছিল। সে সময় নিজের নামেই গানটি গেয়েছিলেন খালেক দেওয়ান। ইউটিউবে খুঁজলে এখনও পাওয়া যাবে।’
দেশের সংগীতশিল্পীদের অধিকাংশই গানটি খালেক দেওয়ানের বলে জানেন উল্লেখ করে সাগর বলেন, ‘বাংলাদেশের আনাচে কানাচে যত শিল্পী আছেন তাদের অধিকাংশই খালেক দেওয়ানের নামে গানটি গেয়েছেন। হাতেগোনা ২-৪ জন রশিদ উদ্দিন সাহেবের নামে গেয়েছেন।’
বিজ্ঞাপন
এবার আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে খালেক দেওয়ানের এ উত্তরসূরি বলেন, ‘যারা আন্দোলন করছেন তাদের আবারও আহ্বান জানিয়ে বলছি, আপনাদের কাছে যদি কোনো উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ থাকে সেগুলো নিয়ে আসুন, প্রমাণ দিন। আমাদের মানতে কোনো অসুবিধা নেই। তবে আমাদের হাতে যে প্রমাণ আছে সেসবের চেয়ে অবশ্যই শক্ত প্রমাণ হতে হবে। এটাই হচ্ছে আমাদের কথা।’
এদিকে গানটি নিয়ে কোনো বিতর্ক না হোক সে প্রচেষ্টা কোক স্টুডিও বাংলার আগে থেকেই ছিল। ইউটিউবে গানটির বর্ণনায় চোখ রাখলে দেখা যায় সেখানে বাউল রশিদ উদ্দিনের নামও উল্লেখ করা হয়েছে। লেখা হয়েছে, ‘মা লো মা লিখেছেন মো. খালেক দেওয়ান (গানটির আরেকটি সংস্করণ লিখেছেন বাউল রশিদ উদ্দিন, নাম মা গো মা)।’ বিষয়টি স্মরণ করিয়ে সাগর বলেন, ‘কোক স্টুডিও বাংলা কখনও বিতর্কিত কিছু করে না। তারা বুঝে শুনে কাজ করে। কারণ এটি ছোটখাটো কোনো প্রজেক্ট নয়। আন্তর্জাতিক মানের কাজ। যার যে সম্মান প্রাপ্য তাকে সেটি দিয়েই কাজ করে তারা। তারা যখন বারী ভাইয়ের কণ্ঠে গানটি শুনেছে কিংবা রশিদ উদ্দিনের নাম দেখেছে তখন ব্র্যাকেটে বিষয়টি লিখে দিয়েছে। রশিদ উদ্দিন সাহেবের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেই এই কাজটি করা হয়েছে। কারণ তিনিও তো একজন সাধক। আমরাও তার গান করে থাকি।’
সবশেষে গানটি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টকারীদের চক্র উল্লেখ করে সাগর বলেন, ‘এটি একটি চক্র। ময়মনসিংহ নেত্রকোনার একটি শিল্পীগোষ্ঠী আছে যারা বিষয়টি মানতে পারছে না। রশিদ উদ্দিন সাহেব ও তার পরিবারকে সম্মান করি। একজন সাধক পরিবারের সদস্য হয়ে আমরা চাইব না আরেকজন সাধকের পরিবার নিয়ে কটাক্ষ করতে। তাই এ বিষয়ে আমরা কোনো পদক্ষেপ নিতে চাচ্ছি না।’
গত ৩ মে কোক স্টুডিও বাংলার ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ পেয়েছে ‘মা লো মা’ গানটি। এতে কণ্ঠ দিয়েছেরন প্রীতম হাসান, সাগর দেওয়ান, আরিফ দেওয়ান ও র্যাপার আলী হাসান। গানটির সংগীতায়োজনে ছিলেন প্রীতম হাসান। প্রকাশের চার দিনে ৪১ লাখের অধিক মানুষ শুনেছে গানটি।