রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

মান্না দে’র গান নিয়ে ব্যবসা করিনি: সুপর্ণকান্তি ঘোষ

রেজওয়ান সিদ্দিকী অর্ণ, রাফিউজ্জামান রাফি
প্রকাশিত: ২৫ এপ্রিল ২০২২, ০২:৫৯ পিএম

শেয়ার করুন:

মান্না দে’র গাওয়া ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা’ গান শুনলে আজও মানুষ নস্টালজিক হয়ে যান। বুকের ভেতর কেমন যেন হাহাকার তৈরি হয়। মনে পড়ে যায় ফেলে আসা সেই দিনগুলোর স্মৃতি। কয়েক দশক ধরে দুই বাংলার বাঙালিরাই এই গানটিকে নিয়ে স্মৃতিকাতরতায় ভোগেন। প্রতি মুহূর্তে গানটি সবুজ পাতার সতেজতা উপহার দেয়। কালজয়ী গানটির সুরকার ছিলেন সুপর্ণকান্তি ঘোষ। সম্প্রতি তিনি প্রথমবার ঢাকায় এসেছেন। সে সুযোগেই এক সন্ধ্যায় তিনি মুখোমুখি হন ঢাকা মেইলের। কথায় কথায় তিনি তাঁর সুরকার জীবনের নানা অধ্যায় নিয়ে মনের আগল খোলেন।

জীবনের পড়ন্ত বেলায় প্রথমবার বাংলাদেশে আসলেন। বড্ড দেরি হয়ে গেল না?

আসব আসব করে এতদিন আসা হয়নি কারণ, পান্নালাল দত্ত বাবুর মতো এমন ভালো লোক পাইনি। আমি ভীষণ চুজি। কার সাথে কথা বলব, কার সাথে মিশব, কার বাড়ি যেতে পারি— এগুলো আমার কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আমি দুম করে কারও বাড়ি যেতে পারি না, সে যত বড়ই হোক। আমার মোবাইলে ঢাকায় আসার অনেক নিমন্ত্রণ রয়েছে। অনেক বন্ধু-বান্ধব আছে এখানে। তাঁরা কেউ জানে না যে, এখানে এসেছি। জেনে থাকলেও আমি যোগাযোগ করব না।

বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনি কতটা জানেন?

বাংলাদেশ সম্পর্কে যে খুব একটা বেশি কিছু জানি, তা নয়। তবে যুদ্ধের সময়ের অনেক কিছু জানি। ১৯৭১ সালে আমার বাবা নচিকেতা ঘোষ বেঁচে। তিনি ‘৭৬ সালে গত হন। যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তখন ব্ল্যাকআউট হত কলকাতায়। ট্রানজিস্টারে বাবা বসে খবর শুনতেন বাংলাদেশের। দেব দুলাল বন্দোপাধ্যায় নামে একজন ঘোষক ছিলেন অল ইন্ডিয়া রেডিওর। তিনি যুদ্ধের সব খবর দিতেন। পাকিস্তানি সেনাদে’র পরাজয়ের খবর শুনে বাবা খুব উচ্ছ্বসিত হতেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে আমি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করি। শুধু তাই নয়, তার কন্যা শেখ হাসিনাকেও অনেক সম্মান করি।

Supornokanti


বিজ্ঞাপন


এখানে আপনার আত্মীয়-স্বজন আছেন। তাঁদের সঙ্গে দেখা করবেন না?

একবারও যাওয়ার কথা মনে হচ্ছে না। ওই যে বললাম, আমি অনেক চুজি। কোথায় আত্মীয়রা আছেন কিংবা তাঁরা আছে কি না— কিছুই জানি না। জানার ইচ্ছাও নেই। তাঁরাও তো খোঁজ নেয়নি আমার। সুতরাং কথা হচ্ছে, আমি যাঁর কাছে এসেছি তাঁকেই চিনি। তাঁর কাছেই থাকছি।

ছোটবেলা থেকে বাবা নচিকেতা ঘোষের সুরারোপিত গানের সঙ্গে বঙ্গো বাজাতেন। তিনি কি চাইতেন আপনি তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন?

একদমই না। বাজানো হয়ে গেলেই শিল্পীদে’র সকলের সামনেই বলতেন, যাও পড়তে বসো। তিনি চাইতেন আমি পড়াশোনাটা ঠিক মতো করি। আমাদে’র ডাক্তার পরিবার। আমার ঠাকুরদা ডাক্তার। তিনি পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের এটেন্ডিং ফিজিশিয়ান ছিলেন। আমার পিসি, পেসো মশাই, জেঠু— এমনকি আমার বাবাও ডাক্তার ছিলেন। আমি বংশের একমাত্র ছেলে। বাবা বেঁচে থাকলে হয়ত ডাক্তারি পড়তাম। আমি মাস্টার্স করেছি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এম কম করেছি। সিআইবি পাশ করেছি। যতটুকু পেরেছি, পড়াশোনা করেছি। বিদেশে গিয়েছিলাম, সেখান থেকে কম্পিউটারে ডিগ্রি নিয়েছি। এ ছাড়া গান-বাজনায় লন্ডন থেকে পিয়ানো, ওয়েস্টার্ন মিউজিক শিখেছি। শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নিয়েছি। তবলা শিখেছি ওস্তাদ গোবিন্দ ঘোষের কাছে। গিটার শিখেছি। জন্ম থেকে বিখ্যাত সুরকার-মিউজিশিয়ানদে’র সঙ্গে থেকে সংগীত এমনিতেই ঢুকে গেছে রক্তে।

বাবার হাত ধরে প্রথম স্টুডিওতে যাওয়ার দিনটির কথা মনে পড়ে?

হ্যাঁ, মনে পড়ে। ঠাকুরমার ঝুলির রেকর্ড করেছিলেন বাবা। এমন জনপ্রিয় বাচ্চাদে’র গান রেকর্ড হয়নি কখনও। সেই রেকর্ডে আমি গেয়েছি মুখ্য চরিত্রে। ছেলে বলে বাবা আমাকে গাইয়েছিলেন তা নয়। আর কাউকে পাচ্ছিলেন না বলে আমাকে নিয়েছিলেন। সুর করার সময় আমি বসে থাকতাম। যে মুহূর্তে আমার থেকে বেটার সিঙ্গার পেয়েছেন তখন আমাকে সেকেন্ড রোলে দিয়ে তাকে মুখ্য চরিত্রে দিয়েছেন।

Supornokanti

এরপর কখনও মনে হয়নি যে, গায়ক হই?

গান কোনোদিন গাইতে ভালো লাগেনি আমার। বিশেষ করে পুরনো গান। তবে দেশ-বিদেশ যেখানে গিয়েছি, সেখানে কেবল ‘কফি হাউজ’ গাইতে হয়েছে।   

প্রথম গান সুর করার গল্পটি কেমন ছিল?

বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁর ফেলে দেওয়া কিছু গানের লেখা আমার কাছে ছিল। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দোপাধ্যায়, শ্যামলগুপ্ত, শিবদাস বন্দোপাধ্যায়ের রিজেক্টেড লিরিক্সগুলো হারমোনিয়ামে সুর করার চেষ্টা করতাম। ওটা বাবার হারমোনিয়াম ছিল। তিনি বেঁচে থাকাকালীন ধরার অনুমতি ছিল না আমার। তিনি মারা যাওয়ার পর সেটা আমার হয়ে যায়। হারমোনিয়ামে গানগুলো সুর করতে ভালো লাগত। তো একদিন নামকরা জার্নালিস্ট ও চলচ্চিত্র পরিচালক অজয় বিশ্বাস ঘরের পর্দা সরিয়ে বললেন, কীরে খোকা কী করছিস? আমি বললাম, এই হারমোনিয়াম নিয়ে গানের সুর করছি। তিনি আমাকে শোনাতে বললেন। আমি শোনালাম। শুনে আমাকে বাহবা দিয়ে চলে যান। অজয় দা তখন ‘সমঝোতা’ সিনেমার শ্যুটিং করছিলেন। শত্রুঘ্ন সিনহা ছিলেন ওই ছবিতে। সেই ছবির শ্যুটিংয়ে বোম্বে যাওয়ার সময় প্লেনে মান্না দে’র সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। তখন তিনি তাকে বলেন, আপনি কি জানেন মান্না দা, নচি বাবুর ছেলে সুপর্ণ গানের সুর করছে। ভালো করছে। আমি শুনলাম। তখন মান্না কাকা বললেন, সুপর্ণ তো বাজাত আমার সাথে। সুর করে নাকি? করে থাকলে খুব ভালো।

মান্না দে তখন বোম্বে থাকেন। মুম্বাই হয়নি সেসময়। মাসে একবার কলকাতায় আসেন ফাংশন করতে। একবার এসে আমাকে ফোন করে বাসায় ডাকলেন। আমি ভেবেছিলাম, তিনি হয়ত বাবার বিষয়ে কিছু জানতে আমাকে ডেকেছেন। গেলাম তাঁর বাসায়। ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করে, সিঙাড়া খাইয়ে বসিয়ে রেখে বাড়ির দোতলায় উঠে গেলেন। কিছুক্ষণ পর একটি খাম নিয়ে ফিরলেন। ভাবলাম, টাকা-পয়সা দেবেন নাকি তিনি! দিলে খুব আত্মসম্মানে লাগবে আমার। আমাকে বললেন, এরমধ্যে সাত মিনিটের একটি গান আছে। অনেকগুলো অন্তরা আছে। পুলক বাবু লিখেছেন। এটা আমি সুর করেছি। এ ছাড়া আরও অনেকে সুর করেছেন। খোকা তোমায় ছোট থেকে দেখছি। যদি তুমি সুর করতে পারো তাহলে ভালো কথা। যদি ভালো না লাগে, তাহলে আমি গাইব না। আমি তখন বললাম, আমার হারাবার কিছু নেই। আমি তো জানতাম না, আপনি আমায় গান সুর করতে বলবেন।

Suporno gauri

মান্না কাকার বাসা থেকে বেরিয়ে হেদুয়ায় দাঁড়িয়ে টু-বি বাসে উঠলাম। টিকিট কেটে বসেছি সিটে। তখন সতেরো-আঠারো বয়স আমার। ফাঁকা বাসে সামনে সিটে পা তুলে দিয়ে হাওয়া খেতে খেতে যাচ্ছি। তখন খামটা পকেট থেকে বের করে দেখছি, কী লেখা!

বাবার মমতা কি বুঝতে না বুঝতেই/এ বিরাট পৃথিবীতে দেখলাম/সে ছাড়া আমার আর কেউ নেই/সে আমার ছোট বোন/বড় আদরের ছোট বোন।

শেষ দুটি লাইন বাসে বসে সুর হয়ে গেল। বাস থেকে নেমে বাড়িতে গিয়ে আমার বোনেদে’র গানের কথা বললাম। তাঁরা খুব খুশি হলো। আমার মনের মধ্যে কী যেন একটা হচ্ছিল! ফ্রেশ হয়ে হারমোনিয়ামটা নিয়ে বসলাম। দু’দিনের মধ্যে সুর করা শেষ হয়ে গেল। হয়ে যাওয়ার পর মাঝে মাঝে গাইতাম নিজে নিজে। তখন মোবাইল ছিল না আজকের দিনের মতো। তাই রেখে দিয়েছিলাম। পরের মাসে মান্না কাকা ফিরে আসলেন কলকাতায়। এসে টেলিফোন করে গানের খবর নিলেন। আমি জানালাম, দু’দিনের মাথায় গানের সুর হয়ে গেছে। তিনি শুনে অবাক হয়ে বললেন, অতবড় গান শেষ করলি কীভাবে? ফাঁকি মেরে করলি নাকি? আমি বললাম, না বাবু। আমার যা মনে হয়েছে তা করেছি।

Manna dey

তারপর আবার মান্না কাকা তাঁর বাসায় ডাকলেন। বাড়িতে যাওয়ার পর গাইতে বললেন। আমি হারমোনিয়াম নিয়ে গাইলাম। গান শেষ হতেই দেখি তিনি হাউমাউ করে কাঁদছেন। আমাকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, খোকা তুমি অনেকদূর যাবে। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, তুমি ভালো-সুস্থ থাকো। দুই বোনকে নিয়ে তুমি এত সুন্দর জীবন যাপন করছ, ভগবান যেন তোমার কল্যাণ করেন।

গানটি গাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন মনা কাকা। যদিও গানটি গাইতে অনেকে বাধা দিয়েছিলেন। তখনকার দিনের গ্রামোফোন কোম্পানি এইচএমভির কর্ণধার বিমান ঘোষ আর পুলক বাবু। পুলক বাবু বললেন, খোকা তো বাচ্চা ছেলে। ও কী সুর করবে মান্না দা? তখন মান্না দে বললেন, আপনারা যে যা-ই বলুন আমি গাইব।

Suparnakanti

ওই সময় গানের মিক্সিংয়ে মিউজিক ডিরেক্টর যেতেন না। এইচএমভির রেকর্ডিস্ট ব্যানার্জী দা করেছিলেন রেকর্ডিং। তার এত ভালো লেগেছিল যে, রোজ সকালে এসে একবার করে চালিয়ে শুনতেন। সেরকম একদিন শুনছেন, ঠিক তখন ভূপেন হাজারিকা ঢুকেছেন। উনি একেবারে অন্য ঘরানার। আমাদে’র কারও সঙ্গে আলাপ নেই। কোনোদিন দেখিনি। তিনি গানটি শুনে কেঁদে ফেলেছেন। ভূপেন কাকা এইচএমভির লোকেদে’র বললেন আমাকে ফোন করতে। আমার সুরে গান গাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলেন। তিনি নিজে আমাকে ফোন করে বললেন, বাবু আমি ভূপেন হাজারিকা। তোমার গান শুনে আমি মুগ্ধ হয়েছি। তুমি আমাকে একটি গান করে দেবে?

বললাম, আপনি বলছেন আর আমি করব না! অবশ্যই করে দেব। ‘ও মালিক সারাজীবন কাঁদালে যখন…’ গানটি করে দিলাম। এই গানটিও সুপারহিট হলো।

দুঃখের কথা হলো, আমি এত গান করেছি। এত হিট গানের সুর করেছি। অথচ লোকেরা জানেই না, গানগুলোর সুরকার আমি। শিল্পীর নামেই জানে গানগুলো। তা তো হবে না। শিল্পী তো আর গাছ থেকে আম পেড়ে খায়নি। গানগুলো তৈরি করেছি আমি।

কেন সুরকার-গীতিকার আড়ালে থেকে যাচ্ছেন বলে মনে হয়?

শ্রোতারা অশিক্ষিত, তাই শুধু কণ্ঠশিল্পীকেই চেনে। তাছাড়া শিল্পীরা অনেক সময় গীতিকার-সুরকারের নাম বলেন না। বলা উচিত। না বললে কী করার আছে!

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারকে তো আপনি ‘আড্ডা’ নিয়ে গান লিখতে বলেছিলেন। এই বিষয়টা নিয়ে কেন লিখতে বলেছিলেন?

ছোট একটা ট্যুরে গিয়েছিলাম প্যারিসে। ওইখানে টিলার মতো একটি জায়গা আছে। ঘোড়ার খুরের মতো স্যুভেনিয়র কফিশপ ছিল। আমাদে’র ট্যুরিস্ট গাউড বললেন— সেখানে বসে সালভাদোর দালি, পিকাসো, স্প্যানিস কবি পাবলো নেরুদার মতো বিখ্যাত মানুষ আড্ডা মারতেন। গল্প করতেন।

তখন আমি ফ্ল্যাশব্যাকে তাঁদে’র সময়ে চলে যাই। দেখেছি, তাঁরা গল্প করছেন। কফি পান করছেন। সময় যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মাথায় ঢুকে গিয়েছিল। ‘৮২ সালের শেষের দিকে এম কম পরীক্ষা দিচ্ছি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কঠিন পরীক্ষা। সারা বছর রোজগার করতে হয়। বাবা চলে গেছেন। স্ট্রাগল করছি। অত পড়াশোনাও করতে পারিনি। শেষ মুহূর্তে খেটে পরীক্ষা দিয়ে ভালো নাম্বার পেয়েছিলাম। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার এসেছিলেন শক্তি ঠাকুরের গান সুর করাতে। আজকের জনপ্রিয় শিল্পী মোনালি ঠাকুরের বাবা শক্তি ঠাকুর। লজ্জার কথা, এভাবে পরিচয় দিতে হচ্ছে। শক্তি দা ভীষণ পন্ডিত লোক। তিনি নেই। মারা গেছেন এক-দেড় বছর হলো।

Manna dey suporno

গৌরী কাকার তখন গলায় ব্যথা। আমার বোনেদে’র অমৃতাঞ্জন নিয়ে গলায় মালিশ করতে বললেন। মালিশ করিয়েছেন। চা পান করেছেন। তখনও আমি আসিনি। ওই সময় তিনি হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, কোথায় রে তুই? কোথায় গেছে সে? আড্ডা মারছে ভেতরে? বিড়ি-সিগারেট খাচ্ছে ভেতরে বসে?

ওই ‘আড্ডা’ শব্দটি আমি শুনেছি। পরে বেরিয়ে এসে বললাম, তুমি শুধু আড্ডা মারতে দেখছো আর বিড়ি-সিগারেট দেখছ? আমার পরীক্ষা সামনে। আমি পড়ছিলাম। আর এত কথা তুমি বলছো, আড্ডা নিয়ে একটা গান লিখতে পারবে?

তখন গৌরীপ্রসন্ন বললেন, তুই কি অক্সফোর্ডের এম এ, যে আড্ডা নিয়ে গান লিখব? তোর বাবা কোনোদিন বলেনি আমাকে। আর তুই বলছিস!

আমি আবার বললাম, হবে না কেন বলো তো? এই যে আমরা শুনি কফি হাউজে ঋত্বিক ঘটক, তপন সিনহা, মৃণাল সেন, অপর্ণা সেন— সবাই গিয়ে আড্ডা দেন। সেখানে কত তর্ক হয়! কত ঝড় ওঠে!

সঙ্গে সঙ্গে গৌরী কাকা বললেন, সাংঘাতিক বলেছিস তো। আমার গলায় ব্যথা, লিখতে পারব না। তুই লেখ, কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই/কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই…।

যতদূর জানি, শেষ স্তবক যোগ করার পক্ষে ছিলেন না গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। আপনি এক প্রকার জোর করে লিখিয়েছেন। তিনি কেন লিখতে চাননি? আর আপনিইবা কেন শেষ স্তবক লেখায় জোর দিয়েছিলেন?

একদম শেষ স্তবক লিখতে চাননি গৌরী কাকা। আমি বলেছিলাম বলেই তিনি লিখতে চাননি। যতদিন বাবা বেঁচে ছিলেন, ততদিন গৌরী কাকা আমার পিতৃতুল্য ছিলেন। বাবা চলে যাওয়ার পর একদম বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন। প্রথম দিকে যতগুলো গালিগালাজ শিখেছি, সবই গৌরী কাকার কাছ থেকে। ভোর পাঁচটার সময় টেলিফোন করে ঘুম থেকে তুলে বলতেন, ঘুমাচ্ছিস কেন? এখনও তো বিয়ে করিসনি। তারপর তিনি নতুন লেখা শোনাতেন।

‘কফি হাউজ’ গানের আগে আমার সুপারহিট গান ছিল ‘সে আমার ছোটবোন’। সেটাতে একটা ফর্মূলা পেয়েছিলাম খুঁজে। গানে একটা জায়গায় ক্লাইমেক্স হয়। দুটি অন্তরা ও একটি সঞ্চারিওয়ালা ছোট গানেও হয়। দ্বিতীয় অন্তরা একটু অন্যভাবে লেখা উচিত। ক্লাইমেক্স নাভির থেকে উঠে জেনিথে যাওয়া উচিত। গ্রাফটা এরকম হওয়া দরকার। যদি পড়ে যায়, তাহলে সে লেখা জমবে না। তাই গানটিকে একটি ক্লাইমেক্স পয়েন্টে নেওয়ার জন্য গৌরী কাকাকে বলেছিলাম। তিনি লিখবেন না। আমার জোরাজুরিতে হাওড়া স্টেশন থেকে সিগারেটের খোসায় লিখে আমাকে পাঠিয়েছিলেন।

গানটি রেকর্ডিংয়ের আগে শাক্তি সামন্তের দেওয়া একটি গিফট এনেছিলেন গৌরী কাকা। রেকর্ডিংয়ের পর খুশি হয়ে একজন পিতার মতো গর্বিত হয়ে আমাকে দুটি জাপানিজ লুঙ্গি উপহার দিয়েছিলেন। পরে তিনি যে কলমটি দিয়ে গানটি লিখেছিলেন, সেটি আমি চেয়ে নিয়েছিলাম। কালির কলম। পেছন দিক দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কালি টেনে খোলা যায়।

Gauriprasanna

গানের চরিত্রগুলো বাস্তব নাকি কেবল কল্পনা?

একদম নয়। এর আগে বহুবার আমি বলেছি। কোনো চরিত্র বাস্তব নয়। সামনে বসে লেখা হয়েছে। সব কাল্পনিক চরিত্র।

মান্না দে আপনার সুরে অন্তত অর্ধশতাধিক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। আপনাদে’র মধ্যে বোঝাপড়া কেমন ছিল?

সব মিলিয়ে ৫৬টি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন মান্না দে। এরমধ্যে পাঁচ-ছয়টি রিলিজ করেনি। আমার কাছে গানগুলো রয়েছে। সেগুলো দিয়ে ব্যবসা করিনি আমি। তিনি আমার নিকট বন্ধুর মতো ছিলেন। আলপিন থেকে এলিফ্যান্ট— সবকিছু তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতাম। তিনিও করতেন।

তাঁর সঙ্গে আপনার এমন কোনো ঘটনা আছে, যা আপনি এর আগে কখনও কাউকে বলেননি?

যে ঘটনাটি বলব, জানি না সেটা বলা উচিত হবে কি না। মান্না দে আমাকে নিষেধ করেছিলেন বলতে। কিন্তু তাঁর নিষেধ ভাঙছি এ কারণে যে, তিনি কত বড় মাপের মানুষ সেটা বোঝাবার জন্য।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্র্যাজুয়েশন পরীক্ষা দেব তখন। এক বছরের ফিস বাকি। একটা টাকাও নেই। পরীক্ষা দেওয়া হবে না। গেলাম মান্না দে’র কাছে। তিনি আমাকে কাছে ডাকলেন। তাঁকে বললাম, খুব অসুবিধায় পড়েছি। গ্র্যাজুয়েশন পরীক্ষা। ফিসটা জমা হয়নি। চার-পাঁচ শ টাকা বকেয়া আছে। শনিবার ছিল সেদিন। রোববার আমার বাদ্যযন্ত্রটা নিয়ে তাঁর কাছে যেতে বললেন। বোনেদে’র বলে আসতে বলেছিলেন যে, রোববার বাড়িতে ফেরা হবে না।

তাঁর কথামতো চারটার সময় চলে আসলাম পরদিন। তিনি দোতলায় ছিলেন। আমি গানের ঘরে বসেছিলাম। নিচে নেমে এসে একটা খাম আমার পকেটে ঢুকিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, চলো আজকে তুমি আমার সঙ্গে বাজাবে। কলকাতার বাইরে কুলটিতে একটি অনুষ্ঠানে ট্রেনে করে গেলাম তাঁর সঙ্গে। সেই অনুষ্ঠানে সব ক্রিম মিউজিশিয়ানস এসে হাজির। অনুষ্ঠানে বাজালাম। গেস্ট হাউজে রাতে থাকলাম। সকালে ফিরলাম কলকাতায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ফিসটা জমা দিলাম।

তিনি আমাকে কলকাতার কোনো অনুষ্ঠানে বাজাতে নিলেন না। কারণ, লোকে যদি বলে নচি বাবুর ছেলে অসুবিধা পড়ায় তাঁকে দিয়ে বাজাচ্ছেন। তিনি আমার কাছে ভগবানের মতো।

Manna dey

তখন নচিকেতা ঘোষ ও গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার সেরা জুটি ছিলেন। কেন সেরা ছিলেন তাঁরা?

বাবা মারা যাওয়ার পর পত্রিকায় গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার লিখেছেন, নচি আর আমি ইংরেজি ভাষার ‘কিউ’ আর ‘ইউ’য়ের মতো ছিলাম। কিউয়ের পর সবসময় ইউ বসে। ওঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক তেমন ছিল। অথচ আমাদে’র মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক ছিল। দেখা হলে ঝগড়া। দেখা না হলে কষ্ট পাওয়া। নচি যে আমাকে এমন কষ্ট দিয়ে চলে যাবে, ভাবতে পারিনি।

বেশিরভাগ গানের প্রথম লাইন বাবার লেখা। এরমধ্যে একটি হলো— যদি কাগজে লেখো নাম, কাগজ ছিঁড়ে যাবে/পাথরে লেখো নাম, পাথর ক্ষয়ে যাবে/হৃদয়ে লেখো নাম, সে নাম রয়ে যাবে। এই অব্দি বাবার লেখা। গানটি মান্না দে’র গাওয়া। সুপার-ডুপার হিট গান।

গৌরী কাকা ও বাবা দুজনে মিলেই এভাবে গান লিখতেন। শুধু তাই নয়, একসঙ্গে অনেক ঝড়ঝাপটা মোকাবিলা করেছেন। এমনকি দুজন একসঙ্গে চুরিও করেছেন। ওড়িয়া কাজের লোক ছিলেন আমাদে’র বাড়িতে। তার কাছে বাবা মানুষ হয়েছিলেন। তিনি লিলি বার্লির কৌটায় করে টাকা জমাতেন। বাবা আর গৌরী কাকা মিলে সেই কৌটা থেকে টাকা চুরি করে শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে কাটলেটের সঙ্গে কষা মাংস খেতেন। এ থকে বোঝা যায় তাদে’র সম্পর্ক কতটা গভীর ছিল! এই সম্পর্কের কারণেই তারা সেরা ছিলেন।

মান্না দে আর ভূপেন হাজারিকাসহ অনেক নামজাদা শিল্পী গান করেছেন আপনার সুরে। তাঁদে’র মধ্যে কে আপনার গান সব থেকে বেশি দরদভরা কণ্ঠে গেয়েছেন বলে মনে করেন?

আমার সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, হৈমন্তী শুক্লা, শিবাজী, কুমার শানুসহ অনেক নামজাদা শিল্পী গান করেছেন। তাদে’র নাম বলতে গেলে দম বন্ধ হয়ে যাবে। একজনের সঙ্গে কারও তুলনা হয় না, তিনি মান্না দে। বাকি যাঁদে’র নাম বললাম, তাঁরাও স্বীকার করবেন এ কথা। মান্না দে একটি গানকে যত্ন করে পরিবেশন করছেন। সন্ধ্যা পিসিও গানকে যত্ন করতেন। হেমন্তু বাবু যত্ন করে গাইতেন।

বাংলাদেশের গান শোনেন?

বাংলা গান শোনা হয় না। তবে বাংলাদেশের ফোক গান আমার ভালো লাগে। আব্বাসউদ্দিনের গান শুনেছি। এখানকার দুটি গানে সুর করেছি আমি। সামনে রেকর্ডিং। ভালো গান করলে এখনও মানুষ শুনবে বলে আমার মনে হয়।

আরএসও

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর