মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী শিক্ষার্থী ডক্টর আব্দুল হামিদ বিন শামসুল হক আজহারির পিএইচডি থিসিস ডিসকাশন সেমিনার বুধবার (২৪ মে) অনুষ্ঠিত হয়েছে। তার গবেষণাপত্রের শিরোনাম ছিল ‘তাফসিরুল মানারের প্রণেতাদ্বয়ের পক্ষ হতে ইমাম বায়যাবি (মৃত্যু: ৬৮৫ হি.), ইমাম আবুস সাউদ (মৃত্যু: ৯৮২ হি.) ও ইমাম আলুসি (মৃত্যু: ১২৭০ হি.) প্রমুখের ওপর আরোপিত অভিযোগসমূহ: সংকলন ও পর্যালোচনামূলক বিশ্লেষণ’।
আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক অ্যান্ড এরাবিক স্ট্যাডিজ অনুষদের তাফসির অ্যান্ড কুরানিক সায়েন্স বিভাগের অধীনে অনুষ্ঠিত ডক্টর আব্দুল হামিদ আজহারির পিএইচডি থিসিস ডিসকাশন সেমিনারের প্রধান সুপারভাইজার ছিলেন তাফসির অ্যান্ড কুরানিক সায়েন্স বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ডক্টর যাকি মুহাম্মাদ আবু সারি। অভ্যন্তরীণ সুপারভাইজার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইসলামিক অ্যান্ড এরাবিক স্ট্যাডিজ অনুষদের প্রাক্তন প্রফেসর ও ডিন ডক্টর মুহাম্মাদ যানাতি আব্দুর রহমান। বহিরাগত সুপারভাইজার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আল-উলুমুল ইসলামিয়া অনুষদের প্রফেসর ও সাবেক ওয়াকিল ডক্টর মাহমুদ খলিফা মাহমুদ।
বিজ্ঞাপন
ডক্টর আব্দুল হামিদ আজহারি ৫ ডিসেম্বর ১৯৮৫ সালে কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ থানার সরসপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মাওলানা শামসুল হক ছিলেন ওই অঞ্চলের বিখ্যাত আলেম। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে ড. আব্দুল হামিদ আজহারি পঞ্চম। তার ভাইদের মধ্যে মুফতি আবুল হাসান আব্দুল্লাহ ও মাওলানা আব্দুল মালেক দেশের বিখ্যাত আলেম।

ডক্টর আব্দুল হামিদ আজহারি কোরআনে কারিমের হাফেজ। তিনি ঢাকার মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া থেকে ২০০৪ সালে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। এরপর আল-মারকাজুল ইসলামিতে আরবি সাহিত্যের ওপর পড়াশোনা করেন। ২০০৬ সালে মিরপুরের মাদরাসা দারুর রাশাদে সাহিত্য সাংবাদিকতা কোর্স সম্পন্ন করেন। একই বছর চট্টগ্রামের পটিয়া মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে দ্বিতীয়বারের মতো দাওরায়ে হাদিসের সনদ অর্জন করেন। ২০০৭ সালের নভেম্বরে তিনি উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশে মিসরে পাড়ি জমান।
ডক্টর আব্দুল হামিদ আজহারি মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক অ্যান্ড এরাবিক স্ট্যাডিজ অনুষদ থেকে ২০১১ সালে ভেরি গুড ফলাফলের সাথে ‘মারতাবাতুশ শরফ’ অর্জন করে গ্রাজুয়েট সম্পন্ন করেন। একই অনুষদের তাফসির অ্যান্ড কুরানিক সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের অধীনে তিনি ২০১৩ সালে মাস্টার্স সমাপ্ত করেন এবং ২০১৭ সালে এক্সিলেন্ট ফলাফলের সাথে এমফিল গবেষণা সম্পন্ন করেন। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে তার পিএইচডি থিসিসের বিষয়বস্তু চূড়ান্ত হয়। তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ ও গবেষণার দীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে আজ অনুষ্ঠিত হয় তার পিএইচডি থিসিস ডিসকাশন সেমিনার।
বিজ্ঞাপন
বিশেষ সাক্ষাৎকারে থিসিসের বিষয় নির্বাচন সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে গবেষক ডক্টর আব্দুল হামিদ আজহারি বলেন, আমার এমফিল গবেষণা থিসিসের জন্য পরামর্শ চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আমার মেজো ভাই বাংলাদেশের সুপ্রসিদ্ধ আলেম ও ‘মারকাজুদ দাওয়াহ আল-ইসলামিয়ার আমিনুত তালিম মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব প্রায় এক যুগ পূর্বে এক চিঠির মাধ্যমে আমাকে আধুনিক যুগে ইসলামি রেনেসাঁর দুই পুরোধা ব্যক্তিত্ব শাইখ মুহাম্মাদ আবদুহু ও শাইখ রশিদ রেজা রচিত সমকালীন তাফসিরগ্ৰন্থ তাফসিরুল মানারের পর্যালোচনা সম্বলিত গবেষণাপত্র লেখার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন। ভাইয়ের পরামর্শেই এ বিষয়ে থিসিস তৈরির সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করি।
আলোচনাকালে গবেষক তার পিএইচডি থিসিসের সহকারী মুশরিফ ডক্টর মুহাম্মাদি আব্দুর রহমান রহ.কে গভীরভাবে স্মরণ করেন। তিনি কয়েক মাস আগে ইন্তেকাল করেছেন। তিনি ছিলেন আল-আজহারের তাফসিরশাস্ত্রের প্রথম সারির একজন আলেম। আশির দশকেও তিনি আল-আজহার মসজিদে দরস দিতেন।
থিসিসের মূল মুশরিফ ডক্টর যাকি মুহাম্মাদ আবু সারির প্রতি কৃতজ্ঞতা আদায় করে তিনি বলেন, আল্লাহ তায়ালা শাইখকে উত্তম বিনিময় দিন। তিনি যখনই আমাকে কোনো কিতাব হাদিয়া দিতেন কিতাবের প্রথম পাতায় লিখে দিতেন ‘মিনাল ওয়ালিদ ইলাল ইবন’ অর্থাৎ, ‘পিতার পক্ষ থেকে পুত্রের জন্য...’।
এছাড়া তিনি তার মরহুম পিতা-মাতার অবদানের কথা স্মরণ করেন। পারিবারিক অভিভাবক বড় ভাই মুফতি আবুল হাসান আব্দুল্লাহ ও মেজো ভাই মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেবসহ দেশের শিক্ষকদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
থিসিস ডিসকাশন সেমিনার শেষে তাফসির ও উলুমুল কুরআন শাস্ত্রে তার এই সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ বিচারক প্যানেলের পক্ষ থেকে সম্মিলিতভাবে তাকে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সর্বোচ্চ ফলাফল ‘মারতাবাতুশ শারফিল উলা’ প্রদান করা হয়। গবেষকের প্রশংসায় ডক্টর মুহাম্মাদ যানাতি আব্দুর রহমান বলেন, আমি আমার শিক্ষকতা জীবনের চল্লিশ বছরে অনেক মুনাকাশায় অংশগ্রহণ করেছি এবং অনেক গবেষণাপত্র দেখেছি, কিন্তু এমন গবেষণাপত্র দ্বিতীয়টি দেখিনি...। এ গবেষণাপত্র থেকে আমি নিজে উপকৃত হয়েছি!”

ডক্টর মাহমুদ খলিফা মাহমুদ বলেন, ‘গবেষক আব্দুল হামিদ তার থিসিসে এমন পাণ্ডিত্যপূর্ণ কিছু অধ্যায় এনেছেন যেগুলোর মাধ্যমে ‘তারকিয়া’ করা সম্ভব! অর্থাৎ, এরূপ শক্তিশালী গবেষণা একজন সহকারী অধ্যাপককে অধ্যাপক স্তরে উন্নীত করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট...!’
দেশি-বিদেশি প্রায় দেড়শ শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে খুবই জাঁকজমকপূর্ণ ইলমি পরিবেশে সেমিনারটি সম্পন্ন হয়। মিসরের কওমি শিক্ষার্থীদের একমাত্র সংগঠন ‘আজহার ওয়েলফেয়ার সোসাইটি বাংলাদেশ, মিসর’ ও মিসরের সব ঘরানার শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্লাটফর্ম ‘বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশন, মিসর’এর দায়িত্বশীলরা দেশের কৃতী সন্তান গবেষক ডক্টর আব্দুল হামিদ আজহারিকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান।
লেখক: শিক্ষার্থী: ইতিহাস বিভাগ, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, মিসর; শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক: বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশন, মিসর।

