বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

‘ক্ষমতাসীনদের দ্বন্দ্বে’র বলি রাবির সাধারণ শিক্ষার্থীরা!

কামরুল হাসান অভি
প্রকাশিত: ১৭ মার্চ ২০২৩, ০৯:০২ এএম

শেয়ার করুন:

‘ক্ষমতাসীনদের দ্বন্দ্বে’র বলি রাবির সাধারণ শিক্ষার্থীরা!

বাসের সিটে বসাকে কেন্দ্র করে শনিবার (১১ মার্চ) বগুড়া থেকে রাজশাহীগামী মুহাম্মদ পরিবহন নামক বাসের চালক ও হেলপারের সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে কথা-কাটাকাটি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক পর্যায় বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর বাজারে স্থানীয় বাসিন্দা ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়। যার ফলে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় ক্যাম্পাস সংলগ্ন বিনোদপুর এলাকা। প্রায় ৫ ঘণ্টাব্যাপী এ সংঘর্ষে উভয়পক্ষের দুই শতাধিক আহত হন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রক্তক্ষয়ী এই সংঘর্ষে উভয়পক্ষের নেতৃত্বেই ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা।


বিজ্ঞাপন


প্রত্যক্ষদর্শী ও ক্যাম্পাসের প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো বলছেন, হাতাহাতির ঘটনা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেওয়ার নেপথ্যে ছিল ক্ষমতাসীনদের আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব। সংঘর্ষের পুরো দায় ছাত্রলীগ ও স্থানীয় ক্ষমতাসীনদের- এমন দাবি করে গত মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ৮টি ছাত্র সংগঠন প্রেস বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করে।

RU Clashসংঘর্ষের সূত্রপাত ছাত্রলীগের মধ্যমেই হয়েছে এমনটা দাবি করে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী সাধারণ সম্পাদক শাকিল হোসেন বলেন, ১১ মার্চ স্থানীয়দের সঙ্গে যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে সেখানে প্রথম থেকেই ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্ট ছিল। ছাত্রলীগের নেতৃত্বেই এ সংঘর্ষ শুরু হয়েছে এবং অপর পক্ষে স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতৃত্ব দিয়েছে। এই সংঘর্ষ ছিল মূলত ক্ষমতাসীনদের আধিপত্যের দ্বন্দ্ব। আর ভুক্তভোগী হয়েছে সাধারণ মানুষ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের সিটগুলো দখল করে আছে এবং সিট বাণিজ্য করছে- এই বিষয়গুলোকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এ আয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হল ফি বৃদ্ধিসহ সামগ্রিক বিষয় ভিন্ন দিকে নেওয়ার জন্য নতুন নতুন ইস্যু তৈরি করছে। তারই একটা অংশ হলো শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষের ঘটনা। ঘটনাটি ইচ্ছে করেই তারা সহিংসতায় রূপ দিয়েছে।

ছাত্র অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাকিব হোসেনও ক্ষমতাসীনদের আধিপত্যের দ্বন্দ্বকেই সংঘাতের মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও বিনোদপুরের কনস্ট্রাকশনের চাঁদাবাজি কেন্দ্র করে মূলত এই সংঘর্ষ লেগেছে। এর দুই দিকের নেতৃত্বে ছিল ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতারা। রাকিব আরও বলেন, সংঘর্ষকেন্দ্রিক তিনটা পক্ষ তিনটা মামলা করেছে। এই মামলাগুলো সবই অজ্ঞাতনামা করা হয়েছে। মামলাগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা যেন হয়রানি শিকার না হয় তার সুষ্ঠু তদন্ত আমরা চাই। তদন্ত মোতাবেক দোষীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে ও আহত শিক্ষার্থীদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।


বিজ্ঞাপন


RU-Clash

রক্তক্ষয়ী এই সংঘর্ষে শিক্ষার্থীদের পক্ষে অবস্থান ছিল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের। অন্যদিকে স্থানীয়দের পক্ষে ছিলেন মহানগর ছাত্রলীগ থেকে শুরু করে যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এতে করে সংঘর্ষটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বলে দাবি করেছেন এলাকাবাসী ও সংশ্লিষ্টরা।

সংঘর্ষের নেপথ্যের কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ওইদিন বগুড়া থেকে রাজশাহীগামী মোহাম্মদ পরিবহনের একটি বাসের সহকারীর সঙ্গে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আল-আমিন আকাশের বাকবিতণ্ডা হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুর ফটকে বাস পৌঁছালে সেখানে ওই বাস সহকারী ও আল-আমিন আকাশের বন্ধুদের হাতাহাতি হয়। সেখানে বিনোদপুরের কিছু ব্যবসায়ী আকাশের বন্ধুদের ওপর মারমুখী হলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া উপস্থিত হন।

পরে সেখানে কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে গোলাম কিবরিয়ার নেতৃত্বে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ বাধে। এক পর্যায়ে স্থানীয়দের ধাওয়া খেয়ে সরে আসতে বাধ্য হয় ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ কর্মীদের এই সংঘর্ষ ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষ’ হিসেবে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার হলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। এর পরই শুরু হয় শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ।

RU-Clashঅনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ঘটনা শুরুর ১ ঘণ্টা পর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান মিশু, সহ-সম্পাদক সাইফুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সভাপতি কাবিরুল ইসলাম রুহুল, সাধারণ সম্পাদক আলফাত সায়েম জেমস, উপ-মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক নিহাদ, জিয়াউর রহমান হল সভাপতি রাশেদ আলী, সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম, নবাব আব্দুল লতিফ হল সভাপতি শুভ্র দেব ঘোষ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হল শাখার সহসভাপতি মেজবাহ, সাখাওয়াত হোসেন শাকিল, খালিদ সাইফুল্লাহ, মতিহার হলের সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর সাহাসহ ছাত্রলীগের প্রায় শতাধিক নেতাকর্মী স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এতে ছাত্রলীগের অন্তত ৩৫ নেতাকর্মী আহত হন বলে ছাত্রলীগ সভাপতি গোলাম কিবরিয়া দাবি করেন।

অন্যদিকে, সংঘর্ষে বিনোদপুরে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের নেতৃত্বে ছিলেন মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি অনিক মাহমুদ বনি, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও বিনোদনপুর বাজার সমিতির সভাপতি শহিদুল ইসলাম শহিদ, থানা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ও বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক আকরাম। তাদের নেতৃত্বে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা একযোগে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ ও শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালান বলে অভিযোগ করেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
মূলত এ হামলা বিনোদপুরের সাধারণ ব্যবসায়ী কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। উভয়পক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক নেতাকর্মী ঢুকে যাওয়ায় এ সংঘর্ষ রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

তবে এই সংঘর্ষের ঘটনায় স্থানীয় ব্যবসায়ীদের নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ও অনিক মাহমুদ বনি। তিনি বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে আমার নিজের দলের অনেক নেতাই আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। এই সহিংসতার সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবি করেন এই নেতা।

RU Clashএই ঘটনায় কোনো পক্ষের উস্কানি ছিল কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সেদিন কি ঘটেছে সেটা বিনোদনপুর গেটে সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখলেই প্রমাণ পাওয়া যাবে। কারা মোটরসাইকেল, পুলিশ বক্স ও দোকানে আগুন দিয়েছে। ওই সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতেই এই ঘটনা ঘটেছে। চারুকলার ডামি পুড়িয়ে রেললাইন অবরোধ ও রেললাইনের স্লিপার উঠানোসহ বিভিন্ন কার্যক্রম কাদের নেতৃত্বে হয়েছে সেটিই প্রমাণ করে এই সংঘর্ষে কারা ছিল। এই ঘটনাটি যারাই ঘটিয়েছে আমরা চাই তাদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া হোক। সেটা হোক শাখা ছাত্রলীগ, স্থানীয় বা অন্য যে কেউ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী এক ব্যবসায়ী বলেন, রাজনীতির মারপ্যাঁচে আমরা সাধারণ ব্যবসায়ীরা নিঃস্ব হলাম আর অন্যদিকে রক্ত ঝরল বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের। মামলা তো হয়েছে, তদন্তও হবে। তবে রাজনীতির কারণেই ঘটনার মূলহোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে।

রাকসু আন্দোলন মঞ্চের আহ্বায়ক আব্দুল মজিদ অন্তর বলেন, আন্দোলনের দিন প্রশাসন ভবনে তালা দিয়ে অবস্থান ও বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ভিসি স্যারের বাসভবনের সামনে অবস্থান করা পর্যন্ত আন্দোলন শান্তিপূর্ণ চলছিল। কিন্তু হঠাৎ ভিসিকে অবরুদ্ধ করা, সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এগুলো আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকেই হচ্ছিল। সংগত কারণেই মনে হয়েছে কোনো একটি মহল আন্দোলনকে উসকে দিচ্ছে।

সংঘর্ষের ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগের বিষয়ে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া বলেন, অভিযোগ তো যে কেউই করতে পারে। আমি ঘটনাস্থলে যাই সংঘর্ষের এক ঘণ্টা পর, সেখানে আমাদের বাইকগুলোও পুড়িয়ে দেয় স্থানীয়রা। ক্যাম্পাসে কোনো সমস্যা তৈরি নয়, আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানেই চেষ্টা করি। শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ নিয়েই ওই দিন কাজ করেছে। সংঘর্ষের শুরু থেকেই প্রশাসনের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নীরব ভূমিকার কারণেই সংঘর্ষটি রক্তক্ষয়ী রূপ ধারণ করেছে বলে জানান তিনি।

RU Clashনগরীর মতিহার থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) আমিনুল ইসলাম বলেন, স্থানীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে মোট ৮শ জনের নামে মামলা করা হয়েছে। আসামি সব অজ্ঞাতনামা। একজনকে আটক করেছি। জড়িত অন্যদেরও আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছি।

সংঘর্ষের ঘটনায় রাজনৈতিক কোনো বিষয় আছে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি।

এদিকে, গত রোববার রাতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের পাশে রেললাইন অবরোধ করে আগুন দেওয়ার নেতৃত্বে ছিল ছাত্রলীগ।

প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মন্নুজান হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি জান্নাত জারাসহ আগুন দেওয়ার পেছনে বেশ কয়েকজন জড়িত ছিল। পরে এর সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীও যুক্ত হয়।

আন্দোলনের পর সার্বিক বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, বর্তমানে ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এখানে সবাই আসবে, কিন্তু কোনো বিশৃঙ্খলা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেব। এখন থেকে সন্ধ্যার পর বহিরাগতদের ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে দেওয়া হবে না।

টিবি/জেএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর