বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

সেশনজটে ইবি, হতাশায় শিক্ষার্থীদের হাঁসফাঁস

রাকিব মিয়া রিফাত
প্রকাশিত: ২৮ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯:০১ এএম

শেয়ার করুন:

সেশনজটে ইবি, হতাশায় শিক্ষার্থীদের হাঁসফাঁস

‘পড়ালেখা যদি একটা ছাত্রের জন্য আশির্বাদ হয়, তবে সেশনজট হলো অভিশাপ। ২০১৮ সালের এইচএসসি পাশ করার পর বাবা-মা ভাবত ছেলে বড় হয়েছে, এবার পরিবারের হাল ধরবে। তাদের উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে বুঝিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডমিট হওয়ার কথা চিন্তা করি। কিন্তু কথাই আছে, অভাগা যে দিকে যায় সাগর শুকিয়ে যায়। ফার্স্ট টাইমে কোথাও চান্স না পেয়ে ভাবি হায়ার-স্টাডি আর করা হলো না। তবুও অনেক কষ্টে ২য় বারে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) ভর্তি হই। ভর্তির সময়ই বাবা জিজ্ঞেস করছিলো আর কতদিন পড়ালেখা করা লাগবে? মাথা নিচু করে বলছিলাম, মোটামুটি ৪-৫ বছরে শেষ হবে। বাবা করুণ সুরে বলছিল এতদিনের খরচ কীভাবে চালাবো।  সংসারের যে অবস্থা তা তো দেখতেই পাচ্ছিস। বাবার কথার জবাব সেদিন না দিয়ে চুপচাপ কেঁদেছিলাম একা বসে। তারপরও অনেক কষ্টে স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। তারপর থেকেই জীবনে নেমে আসে আরেক কালো অধ্যায়। সেশনজটের হিংস্র আক্রমণ জীবনে নেমে আসে। সেই ২০২০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত এই সময়ের ব্যবধানে মাত্র একটা ইয়ার শেষ করতে পেরেছি। বাবা প্রশ্ন করলে চাপা কষ্ট বুকে নিয়ে বলি, আর কিছুদিন একটু কষ্ট করেন, লেখাপড়াটা শেষ হলেই আপনার আর কষ্ট থাকবে না। একা একা ভাবি কবে শেষ হবে আমাদের এই কষ্ট? কবে শেষ হবে পড়ালেখা? কবে ধরবো সংসারের হাল? কেন এই সেশন জট? এটা কি প্রশাসনিক ব্যর্থতা নাকি স্যারদের অবহেলা? কোন উত্তর আমার জানা নেই।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে হতাশা নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন আল-ফিকহ অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মেহেদি হাসান (ছদ্মনাম)।


বিজ্ঞাপন


শুধু আল-ফিকহ বিভাগেই নয়, এরকম ইবির ১২ বিভাগের শিক্ষার্থীরা ভুগছেন সেশনজটে। অন্য সহপাঠীদের চেয়ে কেউ এক সেমিস্টার, কেউ দুই সেমিস্টার, কেউবা ৬ মাস, কেউবা আবার বছর খানেক পিছিয়ে পড়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেশনজটে থাকা বিভাগগুলো হলো— আল-ফিকহ অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ, বাংলা, ইংরেজি, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, আইন, ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি, ম্যানেজমেন্ট, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং, গণিত এবং পরিসংখ্যান বিভাগ। নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা শেষ করতে পারছে না  বিভাগগুলো। নিয়মিত ক্লাস পরীক্ষা না নিয়ে সন্ধ্যাকালীন কোর্সের প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়া, পরীক্ষার তারিখ পেছানো, প্রশাসনিক জটিলতা, রাজনীতিতে শিক্ষকদের ব্যস্ততা ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিসহ নানা কারণে এই সেশনজটের সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন সচেতন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের বেশকিছু বিভাগের শিক্ষার্থীরা ইতোমধ্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। তবে আইন, পরিসংখ্যান ও আল-ফিকহ্ অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগে এখনও স্নাতকোত্তর শেষ হয়নি। এদিকে, বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের মাস্টার্সে এক বছর ধরে ক্লাস চললেও এখনও সেমিস্টার ফাইনালে অংশ নিতে পারেননি তারা। এদিকে আইসিটি ও ম্যাজেনমেন্ট বিভাগে প্রথম সেমিস্টারের ক্লাস চলছে।

২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া কয়েকটি বিভাগের শিক্ষার্থীরা কয়েকমাস আগেই অনার্স শেষ করেছেন। তবে একই শিক্ষাবর্ষের ১১ বিভাগের শিক্ষার্থীরা এখনও অনার্সের গণ্ডি পেরুতে পারেননি। ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের পরিসংখ্যান বিভাগে তৃতীয় বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টার পরীক্ষা, আইন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টার পরীক্ষা এবং আল-ফিকহ্ অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগ, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই), ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) ও গণিত বিভাগের চতুর্থ বর্ষের প্রথম সেমিস্টারের ক্লাস এবং ইংরেজি, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং ও আইসিটি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টারের ক্লাস চলছে। এসব বিভাগগুলোতে ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থীরা অন্য বিভাগের তুলনায় এক থেকে দুই সেমিস্টার পিছিয়ে পড়েছেন।


বিজ্ঞাপন


এসব বিভাগের শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সেশনজটের কবলে পড়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমরা গ্রাজুয়েশন শেষ করতে পারছি না, অথচ অন্য বিভাগের বন্ধুরা আমাদের আগেই পড়াশুনা শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছে। দিন যত যাচ্ছে, হতাশা ততই বাড়ছে। বিসিএস, বিজেএসসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি চাকরি পরীক্ষায় অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছি। এমন দুর্বিষহ সেশনজটের কবল থেকে আমরা রক্ষা পেতে চাই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলা বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, অন্য সহপাঠীদের চেয়ে আমরা সেশনজটে ছয় মাসের মতো আটকে আছি। এতে হতাশায় হাঁসফাঁসের মতো অবস্থা আমাদের। চরম হতাশার মধ্যে দিন পার করছি। মাস গেলে স্যারেরা ঠিকই বেতন পান কিন্তু আমাদের দুর্দশার দিকে তারা ফিরেও তাকান না।

সেশনজটের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) আবুল কালাম আজাদ বলেন, প্রতিটি সেমিস্টার শেষে রিটেক-ইমপ্রুভমেন্ট থাকে, যেগুলো শেষ করতে গিয়ে অনেকসময় সেশনজটের সৃষ্টি হয়। তবে দেখা যায় অনেক শিক্ষকরা রানিং শিক্ষার্থীদের ফলাফলের চেয়ে সন্ধ্যাকালীন কোর্সের ফলাফলের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।

পরিসংখ্যান বিভাগের সভাপতি ড. মোহা. মাহাবুবুর রহমান বলেন, করোনার পরে কয়েকটি সেশনে দ্রুততার সঙ্গে পরীক্ষা নিয়েছি। ৫ মাসে সেমিস্টার শেষ করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাব। আশা করছি, এক/দুই বছরের মধ্যে বিভাগে আর সেশনজট থাকবে না।

শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. তপন কুমার জোদ্দার বলেন, ডিন এবং সভাপতিদের সঙ্গে সেশনজট নিয়ে মিটিং হয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্ট্রাল রিকোভারি প্লান ওভাবে করা হয়নি। আমরা প্রশাসনকে অনুরোধ করবো যাতে একাডেমিক কাউন্সিলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি প্রফেসর ড. মাহবুবুর রহমান বলেন, করোনায় দুটি বছর চলে গেছে, যেটা মেকাপ দেওয়া একটু কঠিন। তবে ঠিক হয়ে যাবে, একটু সময় দিতে হবে। যে বিভাগগুলোতে সমস্যা আছে, আমরা ভেরিফাই করে বিষয়টি দেখব। শিক্ষার্থীরা যেন কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় আমরা প্রতিনিয়ত সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি।

টিবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর