শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

শিক্ষিত হচ্ছে সন্তান, নিঃসঙ্গ হচ্ছেন বাবা-মা

পিয়াস সরকার
প্রকাশিত: ০৯ জানুয়ারি ২০২৩, ১১:৩৩ এএম

শেয়ার করুন:

শিক্ষিত হচ্ছে সন্তান, নিঃসঙ্গ হচ্ছেন বাবা-মা

‘আমার একমাত্র ছেলে নরওয়ের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। পরিচয় দিতে গর্বে বুকটা ভরে যায়। ছেলেকে যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে পাঠিয়েছিলাম এইচএসসি পাসের পরই। সেখানে মাস্টার্স শেষ করে নরওয়েতে ডক্টরেট করল। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলো’- এভাবেই বলছিলেন ধানমণ্ডির বাসিন্দা নওরোজ আলম চৌধুরী। তিনি অবসরে গেছেন ২০১২ সালে, নিজ ফ্ল্যাটে থাকেন স্ত্রীসহ। ছেলের পরিচয় নিয়ে গর্ব করলেও একাকীত্বের হতাশা কণ্ঠে।

তিনি বলেন, ছেলে নরওয়েতেই বিয়ে করে। বউমা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ভারতীয়। আগে প্রতিবছর দেশে আসত। কিন্তু এখন আর সময় পায় না। আমরা বছরে একবার যাই। মাসখানেক থেকে চলে আসি। এই একটা মাসই যেন জীবন। বাকি ১১ মাস অপেক্ষা। করোনার সময় আমার একটা নাতি হয়। কিন্তু অবস্থা এমন ছিল যে যেতেও পারিনি।


বিজ্ঞাপন


রাজধানীর ধানমণ্ডি লেকে ভোরবেলা হাঁটতে বের হন অনেকেই। নানা বয়সী স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের দেখা মেলে। এরমধ্যে তাকওয়া মসজিদের পাশে একত্রে হাঁটা শেষে আড্ডায় মেতে ওঠেন ৮-১০ জন। প্রায় সবার বয়স ৬০ থেকে ৮০ ঘরে। প্রত্যেকের সন্তানই থাকেন দেশের বাইরে। তাদের ভাষায় ‘সেটেল’।

ব্যবসায়ী আলী ইমতিয়াজের তিন ছেলে-মেয়েও বিদেশে ‘সেটেল’। এরমধ্যে ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় আর দুই মেয়ে থাকে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রে। প্রতিদিন ভোরে স্ত্রীকে নিয়ে হাঁটতে বের হন। বয়সের ভারে হাঁটার গতিও খুব কম। স্ত্রী রাবেয়া সুলতানা বলেন, আমার ছয়টা নাতি-নাতনি। সারাদিন অপেক্ষা করি কোন দেশ থেকে ফোন আসবে। কে আমাকে নানি বা দাদি বলে ডাকবে। ছেলে ঈদের সময় দেশে আসে। এই সময়টার জন্য অপেক্ষায় থাকি।

এক প্রশ্নের জবাবে এই দম্পতি বলেন, শেষ বয়সটা এভাবেই কাটাতে হবে। আমাদের দেখাশোনার মানুষ আছে দুজন। কিন্তু রক্তের সম্পর্কের কেউ নাই। ভয় হয় আমাদের একজন চলে গেলে আরেকজনের একা কীভাবে কাটবে। মাঝে মাঝে এমন একা লাগে যে কথা বলার জন্য কান্না পায়। আর অসুখ তো লেগেই আছে।

শিক্ষা ও স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানই পাড়ি দিচ্ছেন বিদেশে। আর মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের অধিকাংশের গন্তব্য রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা শহর। এদের অধিকাংশই আর ফিরছেন না নিজ বাড়িতে। সেটেল হচ্ছেন বিদেশে বা বড় শহরে। বাবা-মায়েরা সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুললেও জীবন সায়াহ্নে এসে হয়ে পড়ছেন একা। সন্তানদের মানুষ করতে গিয়ে সারা জীবন কষ্ট করার পর শেষ জীবনে এসে একাকীত্বের যন্ত্রণা মেনে বাধ্য হচ্ছেন তারা।


বিজ্ঞাপন


রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আমিনুল ইসলামের এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ে ব্যাংকে চাকরি করে, স্বামীসহ থাকে ঢাকায়। ছেলে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা। ছেলে-মেয়েকে নিয়ে গর্বের অন্ত নেই আমিনুল ইসলামের। তিনি বলেন, ছেলে-মেয়েকে মানুষ করতে পেরেছি- এটাই আমার তৃপ্তি। বাচ্চা দুইটা যখন এইসএসসি পাস করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেল, তখনই আমি ওদের মাকে বলেছিলাম, ছেলে-মেয়ে যদি মানুষ হয় তাহলে এই বাড়িতে থাকা শেষ। আর যদি শিক্ষিত-প্রতিষ্ঠিত না হতে পারে তাহলে আবার এই বাড়িতে ফিরে আসবে।

তিনি আরও বলেন, আমার বড় ভাইয়ের দুই ছেলে। দুজনই এলাকাতেই ব্যবসা করে। বাড়িতে থাকে। আমার ভাই ভাবিও নাতি-নাতনি নিয়ে সুখেই আছে। বিপদে-আপদে-অসুখে ছেলে, ছেলের বউয়ের সেবা পায়। কিন্তু আমরা অপেক্ষা করে থাকি কবে দুই-তিনদিনের জন্য সন্তানরা বাড়িতে আসবে। প্রাক্তন এই শিক্ষক বলেন, ছেলে-মেয়ে সাথে থাকলে অবশ্যই ভালো লাগতো। কিন্তু কি করব, উপায় নাই।

অন্যদিকে নিম্নবিত্ত পরিবারের বাবা-মায়েদের অবস্থাও প্রায় একইরকম। দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলায় একা থাকেন শিউলি আক্তার। তার স্বামী সৌদি আরবে কাজ করতেন। সেখানেই দুর্ঘটনায় মারা গেছেন প্রায় ছয় বছর আগে। শেষ দেখাটাও হয়নি। এখন একমাত্র ছেলে থাকে ঢাকায়। তিনি বলেন, কি করব, কন? ব্যাটায়তো ঢাকায় থাকতে বলে। কিন্তু ঢাকায় বেশিদিন ভালো লাগে না। এলাকায় না থাকলে মন টেকে না। ব্যাটা চাকরি করে টাকা পাঠায়, তাই দিয়ে চলি। অনেক কষ্ট কইরা মানুষ করছি। এখন চাকরি না করে আমার জন্য বাড়িতে চলে আসুক সেটাও চাই না।

তিনি আরও বলেন, আমার বাতের ব্যাথা। ব্যাথা উঠলে একটু মালিশ করলে আরাম হয়। ঈদে যখন ব্যাটা আসলো, রাতে ব্যাথা উঠলো বউ মালিশ করে দিলো। কিন্তু এখন রাতে ব্যাথা উঠলে মুখ বুজে থাকি।

এসব বিষয় নিয়ে কি বলছেন সন্তানরা?
আমেরিকা প্রবাসী ইফতাখারুল আলম বলেন, বাবা-মাকে একা দেশে রেখে আসতে কখনই চাইনি। তাদের এখানে এনে রাখতে চাই। তারা থাকতে পারেন না। হাঁপিয়ে ওঠেন। আমার সারা জীবন আমি স্বপ্ন দেখেছি নিজেকে প্রস্তুত করেছি দেশের বাইরে সেটেল করব। এখন আমি বাবা-মায়ের জন্য দেশে ফিরে যেতেও পারছি না। বাবা-মায়ের কষ্ট হয় এটা জানি। বৃদ্ধ বয়সে একা থাকাটাও কষ্টকর কিন্তু আমি যে নিরুপায়।

ঢাকায় থাকা প্রকৌশলী ইমরান খন্দকার বলেন, আমি ঢাকায় না থাকলে চাকরি মিলবে না। আব্বু বাড়িতে একা থাকেন। মা মারা গেছেন। ঢাকায় এসে থাকতে পারেন না আব্বু। আমি পড়েছি উভয় সংকটে। আব্বুকে একা রেখে শান্তিতে থাকতে পারছি না। আবার এলাকায় ফিরেও যেতে পারছি না।

ঢাকায় একটি কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন ইলিয়াস হোসেন। তিনি বলেন, বাড়িতে থাকতে তো চাইছিলাম। নিজের বাড়িতে থাকতাম। বাড়ি ভাড়া লাগতো না। কিন্তু কাজ জোটাতে পারলাম না। তাই পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকি। বাবা-মা এলাকায় একা থাকে। আমার তিন বোনের সবার বিয়ে হয়ে গেছে। বাবা-মাকে একা রাখতে বাধ্য হয়েছি।

উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত- কোনো মা-বাবাই শেষ বয়সে এসে নতুন পরিবেশে যেতে চান না। অন্যদিকে শিক্ষা, চাকরি কিংবা আধুনিক জীবন- যে কারণেই হোক সন্তানরা শহর বা বিদেশমুখী হচ্ছেন। ফলে নিঃসঙ্গতায় ভুগছেন বৃদ্ধ বাবা-মা। শেষ বয়সে মোবাইল কিংবা ইন্টারনেটে সন্তান, নাতি-নাতর মুখ দেখে ও স্বজনদের ঘুরতে আসার অপেক্ষায় সময় কাটে তাদের।

শহরমুখী হওয়ার এই প্রবণতা উঠে এসেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) এক গবেষণাতেও। এতে দেখা যায়, ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় (মেগাসিটি) প্রতিদিন নতুন ১ হাজার ৭০০ মানুষ যুক্ত হয়।

২০১৪ সালে রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগে ভর্তি হওয়া দুই সেশনের শিক্ষার্থীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই দুই সেশনে ভর্তি হয়েছিলেন ২৪ ও ২৮ জন শিক্ষার্থী। যাদের ২০১৮ সালে অনার্স শেষ হয়। এই ৫২ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪৭ জনই ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের বাইরের এলাকার থেকে এসেছেন। ৫২ জনের মধ্যে দেশের বাইরে গিয়েছেন ১২ জন। নিজ এলাকায় ফিরে গেছেন ৭ জন। আর ২ জন অন্য শহরে চাকরি করছেন। বাকিরা থাকছেন ঢাকায়।

এ বিষয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, আমাদের সমাজে বাবা-মায়ের শেষ সময়ে সন্তান পাশে থাকতে পারছে না বা দেখভাল করতে পারছে না। কিন্তু তাতে তো মানুষের স্থান পরিবর্তনে ভাবনাটা থেমে নেই। চাকরি, শিক্ষা ছাড়াও নানা কারণে স্থান পরিবর্তন করতে হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি আমরা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছি না। কারণ আমাদের সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কোনো ব্যবস্থা নেই। অভিভাবক একা থাকছেন, তিনি কোথায় থাকবেন? দেখভালের লোক না থাকলে চিকিৎসার ব্যবস্থা কি হবে, খাবারের ব্যবস্থা কি হবে- এই ব্যাপারগুলো নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকতে হয়।

তিনি আরও বলেন, সমাজে নির্ভরতার সম্পর্ক তৈরি করা সম্ভব হয়নি। যা আমাদের আঘাত দেয়। ফলে সন্তান যখন পাশে থাকে না তখন অভিভাবকদের মধ্যে একাকীত্ব-হতাশা কাজ করে। সারা বিশ্বেই প্রবীণ জনগোষ্ঠী বাড়ছে। যার কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ রাষ্ট্রীয় কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আমাদের এখানেও কিছু আছে কিন্তু পর্যাপ্ত নয়। আজ থেকে ৩০ বছর আগে বসবাসের যে ধারণা ছিল সেটি পরিবর্তন হয়েছে। সামনেও হবে। এখন যারা নবীন আছেন তাদের আত্মনির্ভশীলতার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রবীণদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম নেয়া উচিত। অন্যথায় এই ধরনের আবেগগত জটিলতায় পড়তে হবে।

পিএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর