শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

ইবতেদায়ী শিক্ষকরা কবে পাবেন ‘শিক্ষকের সম্মান ও মর্যাদা’

পিয়াস সরকার
প্রকাশিত: ১৮ ডিসেম্বর ২০২২, ০৮:২৬ এএম

শেয়ার করুন:

ইবতেদায়ী শিক্ষকরা কবে পাবেন ‘শিক্ষকের সম্মান ও মর্যাদা’

‘সংসার চলছে কোনোভাবে। আব্বা কিছু জমিজমা রেখে গেছেন, সেগুলো দিয়েই চলে। তারপরও ধারদেনা লেগেই আছে। ১৬ বছর ধরে শিক্ষকতা করি, ছেলে-মেয়ের কোনো শখ-আহ্লাদ পূরণ করতে পারি না। কী করব? আমি তো অসহায়। আমি ডায়াবেটিস ও প্রেশারের রোগী। স্ত্রীর মাজা ব্যথা। ভালো চিকিৎসাও করাতে পারি না।’

এভাবেই নিজের কষ্টের কথা বলছিলেন গাইবান্ধার ঢোলভাঙা উপজেলার স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষক ওবায়দূর রহমান। তিনি বলেন, রাস্তা দিয়ে যখন যাই, সবাই হুজুর বলে, কেউ বলে স্যার। শুনতে ভালোই লাগে। সমাজে আমাদের সম্মান আছে, নাই শুধু অর্থ। শুধু সম্মান দিয়ে কি বাঁচা যায়? কতদিন যে না খেয়ে ক্লাস নিয়েছি তার হিসাব নাই।


বিজ্ঞাপন


মাসে ২,৫০০ টাকা বেতন পান বরগুনা জেলার শিক্ষক আসমানি আনজুম। তিনি বলেন, একবার ভেবে দেখেন, দিনে আমি ১০০ টাকা করেও পাই না। ২০০২ সাল থাকে চাকরি করি। ছেলে-মেয়েরা বলে কেন প্রতিদিন রিকশা ভাড়া দিয়ে মাদরাসায় যাও? আমি কিছু বলতে পারি না। সারাটা জীবন ও শ্রম দিলাম। কী পেলাম? কিছুই পেলাম না।

তিনি আরও বলেন, আমরা আন্দোলন করলাম। ঊর্ধ্বতন মহলে দাবির কথা জানানো হলো। কিন্তু কোথায় তার বাস্তবায়ন?

এভাবে আন্দোলন ও আশ্বাসে আশ্বাসেই কেটে গেছে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা শিক্ষকদের ৩৮ বছর। এই দীর্ঘ সময়ও বেতন পাননি প্রায় ২০ হাজার স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষক। বোবা কান্না থামছে না এই শিক্ষকদের। তাদের ঘরে শুধুই অভাব আর অভাব। সম্মান থাকলেও নেই অর্থ।

১৯৮৪ সালে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড ১৮ হাজার স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসার অনুমোদন দেয়। যদিও তখন সরকারি কোনো সুবিধা দেওয়া হতো না। হাজার হাজার শিক্ষক বিনা বেতনেই শেষ করেছেন কর্মজীবন। তবে তবে পরবর্তীতে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসার সংখ্যা কমে যায়। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০২১ সালের তথ্যানুযায়ী বর্তমানে দেশে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা রয়েছে মাত্র ৩ হাজার ৮৩৯টি। যেগুলোতে প্রায় ২০ হাজার শিক্ষক রয়েছেন।


বিজ্ঞাপন


৩ হাজার ৮৩৯টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসার মধ্যে ১৯৯৪ সালে ১ হাজার ৫১৯টির শিক্ষকদের জন্য মাথাপিছু মাসিক ভাতা ৫০০ টাকা নির্ধারণ হয়। ২০১৩ সালে এসব শিক্ষকদের ভাতা বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করা হয়। পরের বছর মহার্ঘ্যভাতা হিসেবে ২০০ টাকা যোগ করে মোট ১২০০ টাকা দেওয়া হয়। আর ২০১৭ সালে সেই ১ হাজার ৫১৯টি মাদরাসার প্রধান শিক্ষকদের মাসিক ভাতা ২৫০০ টাকা ও সহকারীদের ২৩০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

বাকি ২,৩২০টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষকরা সরকারের এই সামান্য ভাতাও পান না।

শিক্ষকরা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে তাদের সঙ্গে অন্যায় করা হচ্ছে। তারা সঠিকভাবে কাজ করলেও দেয়া হচ্ছে না সম্মান। অভাব অনটনে জর্জরিত শিক্ষকরা।

শুধু তাই নয়, এসব মাদরাসার শিক্ষার্থীরাও বঞ্চিত হচ্ছে। ইবতেদায়ী মাদ্রাসার ১০ হাজার ছাত্রছাত্রীকে উপবৃত্তি দেয়া হতো। কিন্তু গত বছর থেকে এই উপবৃত্তিও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

এ জন্য ইবতেদায়ী শিক্ষকরা একাধিকবার আন্দোলনে নামেন। ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে আট দিন তারা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নেন। দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাসে তারা ঘরে ফেরেন। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসার জন্য ‘এমপিও ও জনবল কাঠামো নীতিমালা ২০১৮’ জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু নীতিমালাটি চার বছরেও কার্যকর হয়নি।

স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষক ফোরামের আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম বলেন, আমাদের সঙ্গে প্রহসন করা হচ্ছে। প্রাথমিকের শিক্ষকরা কত সুবিধা পাচ্ছেন, আমরা কেন পাচ্ছি না? তারাও শিক্ষক, আমরাও শিক্ষক। কিন্তু আমাদের কান্না পৌঁছায় না উপর মহলে।

তিনি আরও বলেন, ইবতেদায়ী মাদরাসাগুলোকে নিয়ে একটি গবেষণা হচ্ছে। এই গবেষণার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা আশাবাদী আমাদের স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসাগুলো জাতীয়করণ হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর কায়সার আহমেদ বলেন, আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে একটি সমীক্ষা করছি। এই সমীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা শিক্ষকদের সুযোগ সুবিধা বাড়ানো হবে। সমীক্ষা হাতে পেলে আমরা শিগগিরই তা বাড়ানোর পরিকল্পনা হাতে নেব।

জানা গেছে, ‘স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসাগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি: একটি সমীক্ষা’ শীর্ষক গবেষণার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটকে দায়িত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে জানান হয়, এই সমীক্ষার জন্য ৫-৬ মাস সময় লাগবে।

পিএস/জেএম/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর