হাজারো শিক্ষার্থীদের গান, গল্প, প্রেম, ভালোবাসা ও নানা আন্দোলন জড়ানো স্মৃতির নাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ‘প্যারিস রোড’। ৫০ বছরের পুরনো এই ‘প্যারিস রোড’। এই সড়কটির দু’ধারের সুমহিমায় দাঁড়িয়ে থাকা ৩০-৪০ মিটার সুউচ্চ গগনশিরীষ গাছ ও পিচঢালা পথ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য।
পাঁচ দশকের ঐতিহ্য ধারণ করে দাঁড়িয়ে থাকা এই সড়কটি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের রাস্তার সঙ্গে সাদৃশ্যতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা গেট থেকে শেরে-ই-বাংলা হল পর্যন্ত দীর্ঘ রাস্তাটি প্যারিস রোড নামেই পরিচিত হয়ে উঠেছে।
বিজ্ঞাপন
তবে প্যারিস রোডের দু’পাশঠাসা গগনশিরিষ গাছের দৃশ্যের কিছুটা বিপর্যয় ঘটেছে গত কয়েক বছর ধরে। বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগে বেশকিছু গাছ ভেঙে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় কতৃর্পক্ষও নানা অযুহাতে বিভিন্ন সময় গাছ কেটে ফেলেছে। ফলে ঘন আটা পাতার শামিয়ানায় কয়েক জায়গা ছিঁড়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাস্তাটির পরিচর্যা নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে।

রাবির প্যারিস রোডের দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিখ্যাত এই গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Albizia lebbeck। শিরীষ Albizia গণের একটি প্রজাতি। স্থানীয়ভাবে গগনশিরীষ নামে পরিচিত। যার আয়ুকাল ৫০ থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। এটি মূলত ইন্দোমালয়, নিউগিনি ও উত্তর অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলের উদ্ভিদ। তবে ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলে এই উদ্ভিদ চাষ হয় অথবা স্বাভাবিকভাবে জন্মায়।
গাছগুলোর আয়ুষ্কাল সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. গোলাম কবিরের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গাছগুলোর আয়ু সাধারণত ৫০ থেকে ৬০ বছর। এখানে ১৯৬৫ সালে লাগানো হয়েছিল গাছগুলো। যা তাদের জীবনকালের শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। সে হিসেবে আর মাত্র কয়েক বছর বাঁচতে পারে গাছগুলো। এরপর গাছগুলো রোগাক্রান্ত হয়ে ধীরে ধীরে মারা যাবে।’
বিজ্ঞাপন
১৯৬৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধিকরণের উদ্যোগ নেয় প্রশাসন। তৎকালীন উপাচার্য এম শামসুল হক ফিলিপাইন থেকে নিয়ে আসেন কিছু গগনশিরীষ গাছ। তিনি এই গাছগুলো রোপণের দায়িত্ব দেন উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যানকে। তার হাত ধরেই ক্যাম্পাসের কাজলা রোড থেকে শের-ই-বাংলা হল পর্যন্ত এই গগনশিরীষ গাছগুলো লাগানো হয়।
তবে এই গাছগুলি তাদের আয়ুষ্কালের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। প্রতিনিয়ত থাকছে ঝড়-বৃষ্টির ঝুঁকিতে। ২০১৯ সালে, ঝড়ের কবলে পড়ে উপাচার্যের বাসভবনের পাশের দেয়ালে একটি গাছ উপড়ে যায়। ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে বিগত বছরগুলোতে রাস্তার পাশের বেশ কিছু গাছ কেটে ফেলা হয়েছে, এতে রাস্তার সৌন্দর্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।

সাবেক উপাচার্য এম আব্দুস সোবহানের আমলে প্রণীত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ বছরের ‘মাস্টারপ্ল্যান’-এ ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যেখানে প্যারিস রোডও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের একটি দল বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী স্থানটির পরিচর্যার জন্য কাজ করছে। উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাবরিনা নাজের নেতৃত্বে দলটি গগন শিরীষের চারা জন্মানোর এবং বয়স্ক ও মৃত স্থানে তা লাগানোর চেষ্টা করছে।
জানতে চাইলে অধ্যাপক নাজ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘অনেক প্রচেষ্টার পর, বিশেষ করে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের উদ্যানরক্ষকদের কাছ থেকে আমরা গগন শিরীষের চারা পুনরুৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছি। ধীরে ধীরে উপড়ে ফেলা ও কেটে ফেলা গাছের জায়গায় গাছের চারা রোপণ করে নিরন্তর প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্যারিস রোড এবং এর সৌন্দর্য সংরক্ষণ করতে সক্ষম হবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তবে সার্বিক বিপর্যয় পেরিয়ে প্যারিস রোডের সৌন্দর্য অক্ষুণ্ণ থাকবে এমনটাই আশা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা।
তারা বলেন, ‘এই প্যারিস রোড আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য। যে ঐতিহ্য আমাদেরকেই রক্ষা করতে হবে। প্যারিস রোড বেঁচে থাকবে অন্ততকাল, আমাদের মনে-প্রাণে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্যারিস রোড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে একীভূত।’
টিবি

