শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দু’দিন ছুটি: লাভ না ক্ষতি?

সেলিম আহমেদ
প্রকাশিত: ২৪ আগস্ট ২০২২, ১১:৪৯ এএম

শেয়ার করুন:

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দু’দিন ছুটি: লাভ না ক্ষতি?
ছবি: ঢাকা মেইল

বৈশ্বিক মহামারি করোনায় প্রায় দুই বছর বন্ধ ছিল দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে ব্যাপক শিখনঘাটতির মুখে পড়তে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। সেই ক্ষতি পোষিয়ে ওঠার আগেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ে নানামুখী পদক্ষেপের অংশ হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ নিয়ে শিক্ষক-অভিভাবক ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মাঝে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তারা বলেছেন— শিখনঘাটতি পূরণে যেসব পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন আগে জরুরি। তা না করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন করা যৌক্তিক হয়নি। কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খুবই একটা বিদ্যুৎ ব্যয় হয় না। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে— সপ্তাহে ২ দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে শিক্ষার্থীদের কোনো ক্ষতি হবে না। বরং শিক্ষার্থীরা এনার্জি নিয়ে পড়ালেখা করতে পারবে।

করোনার কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকে টানা প্রায় ১৮ মাস সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরাসরি পাঠদান বন্ধ ছিল। তবে বন্ধের ওই সময়ে টেলিভিশন, রেডিও ও অনলাইনে ক্লাস নেওয়াসহ নানাভাবে শিক্ষার্থীদের শেখানোর কার্যক্রম অব্যাহত রাখার চেষ্টা ছিল; যদিও এসব কার্যক্রমে সব এলাকার শিক্ষার্থীরা সমানভাবে অংশ নিতে পারেনি।


বিজ্ঞাপন


মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন শাখার এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে— করোনার মধ্যে গত বছর দেশের অর্ধেকের বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৪ লাখ ৮১ হাজার শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে ৪৭ হাজারের বেশি ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়েছে। আর শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে প্রায় ৭৮ হাজার শিক্ষার্থী। অন্যদের অনুপস্থিতির সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় দেশের ৪ কোটির বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে উঠে এসেছিল জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসফের এক গবেষণায়। ২০২১ সালের আগস্টে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে মহামারির পুরোটা সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চতর শিক্ষার স্তর পর্যন্ত চার কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিটের (বেডু) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, করোনাকালে ২০২১ শিক্ষাবর্ষে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের (বর্তমানে নবম শ্রেণিতে পড়ছে) অর্ধেকেরও বেশির বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে মধ্যম ও উচ্চমাত্রায় শিখনঘাটতি তৈরি হয়েছে, যা পূরণ করতে বলা হয় ওই গবেষণায়। তবে জেলা বিবেচনায় পার্বত্য অঞ্চলের তিন জেলায় পরিস্থিতি আরও খারাপ।


বিজ্ঞাপন


বেডুর এই গবেষণার তথ্য আমলে নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) মাধ্যমে শিক্ষার ঘাটতি পূরণে বিস্তারিত একটি কর্মপরিকল্পনা করেছে। এটি এখন বাস্তবায়নের কথা।

এনসিটিবি বলছে— প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বাংলায় ১৫টি, ইংরেজিতে ১৭টি ও গণিতে ১৫টি মিলিয়ে মোট ৪৭টি অতিরিক্ত ক্লাস পরিচালনা করতে হবে। আর রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে যেহেতু ঘাটতি থাকা শিক্ষার্থীর হার অনেক বেশি, তাই ওই সব এলাকার জন্য আরও বেশিসংখ্যক অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে হবে।

এমন পরিস্থিতিতে এসে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সোমবার (২২ আগস্ট) বিকেলে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ের নিমিত্তে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের আওতাধীনস্থ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুক্র ও শনিবার বন্ধ থাকবে।

যদিও বর্তমানে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সাধারণত দুই দিন সাপ্তাহিক ছুটি থাকে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন। তবে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সাপ্তাহিক ছুটি এক দিন। এ জন্য বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে এক দিন সাপ্তাহিক ছুটি থাকে।

অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুই দিন বন্ধ রাখলে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে সেই তথ্য নেই সংশ্লিষ্টদের কাছে। তাই বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুই দিন বন্ধ অযৌক্তিক বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।

শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. একরামুল কবির বলেন, ‘পরিস্থিতি বিবেচনায় হয়তো সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এই সিদ্ধান্তে উপকারের চেয়ে ক্ষতিটা বেশি হবে। কারণ শহরের মতো গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ খরচ হয় না। ঢাকা শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবশ্যই ব্যয় আছে। কিন্তু জেলা পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তেমন ব্যয় নেই।’

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান ঢাকা মেইলকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুই দিন বন্ধ রাখা দরকার ছিল না। এর একটি কারণ হলো- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কত বিদ্যুৎ আর খরচ হয়। কয়কটা স্কুল-কলেজে ফ্যান এসি আছে। তবে এখানে একটা কথা আছে যে বড় বড় প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে ক্লাসে যায়। এতে ব্যাপক জ্বালানি খরচ হয়। এটা সরকার আগেও বন্ধ করতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। সরকার স্কুলে স্কুলে বাস দিয়েছিল কিন্তু বড় লোক ও এলিট শ্রেণির অভিভাবকরা তাদের সন্তানকে বাসে ছড়াতে চান না।

অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বলেন, জ্বালানি সাশ্রয় করতে হলে প্রথমে সরকারি গাড়ির বেসামাল ব্যবহার বন্ধ, বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে হবে। সরকারি গাড়ি সরকারি কাজ ছাড়া কোথাও ব্যবহার করা যাবে না। স্কুল বন্ধের নামে ‘টোটকা’ চিকিৎসা দিয়ে এসব সামাধাণ করা যাবে না।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন শাখার এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে— করোনার মধ্যে গত বছর দেশের অর্ধেকের বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৪ লাখ ৮১ হাজার শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে ৪৭ হাজারের বেশি ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়েছে। আর শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে প্রায় ৭৮ হাজার শিক্ষার্থী। অন্যদের অনুপস্থিতির সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান বলেন, ঢাকার বাইরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ- জ্বালানি খুবই কম খরচ হয়। তারপরও দেশের একটা ক্রাইসিস হয়েছে তাই আমরা কিছুদিন দেখতে পারি। সরকার যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা ভালো বুঝে।

শিক্ষাবিদ এ এন রাশেদা বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এতো বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় না। দু’একটা পাবলিক ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান ছাড়া অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে এসি নেই। দিনেও বেলা লাইটেরও প্রয়োজন হয় না। তাই দুই দিন বন্ধ রাখার অযৌক্তিক।

এদিকে সপ্তাহে ২ দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে শিক্ষার্থীদের কোনো ক্ষতি হবে না বলে মনে করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তার মতে— এতে শিক্ষার্থীরা এনার্জি নিয়ে পড়ালেখা করতে পারবে।

মঙ্গলবার (২৩ আগস্ট) দুপুরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আগামী বছর থেকে সপ্তাহে দুই দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কথা ছিল আমাদের। এখন বৈশ্বিক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট চলছে। এই সময়ে আমরা যেন সাশ্রয় করতে পারি, এ কারণেই এখন থেকে এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।

তিনি বলেন, এতে আমদের সপ্তাহে পাঁচ দিন ক্লাস হবে। পাঁচ দিনেই আমাদের যে পরিকল্পনা রয়েছে, সে অনুযায়ী আমরা ক্লাস করাব। এ কারণে আমরা মনে করি না যে শিক্ষার্থীদের কোনো ক্ষতি হবে। বরং অন্যান্য কর্মজীবী সপ্তাহে দুই দিন ছুটি পান, তাদের মতো আমাদের শিক্ষকরাও ছুটি পাবেন।

‘কারণ শিক্ষকরা অন্যান্যদের তুলনায় বছরে ৫১ দিন বেশি কাজ করেন। সেই শিক্ষকেরা যদি সপ্তাহে দুই দিন ছুটি পান, সেক্ষেত্রে শিক্ষকরা নিজের একটু কাজ করতে পারবেন। একটু বিশ্রাম নিয়ে বাকি পাঁচ দিন তারা আরও উদ্যোমী হবেন। আরও অনেক বেশি এনার্জি নিয়ে কাজ করবেন বলে আমরা মনে করি।’

এসএএস/এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর