শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

ভুয়া সনদে এক যুগ ধরে মাদরাসায় শিক্ষকতা

দেলাওয়ার হোসাইন দোলন
প্রকাশিত: ১৮ আগস্ট ২০২২, ১১:০১ এএম

শেয়ার করুন:

ভুয়া সনদে এক যুগ ধরে মাদরাসায় শিক্ষকতা

আরেকজনের সনদে নিজের নাম বসিয়ে মাদরাসায় চাকরি নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে মো. শফিকুল ইসলাম নামে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে। সনদ জালিয়াতির বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে এলেও অজানা কারণে নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। ফলে গত ১২ বছর ধরেই জাল সনদ দিয়েই চাকরি করে আসছেন অভিযুক্ত এই শিক্ষক।

অভিযোগ রয়েছে, শফিকুল ইসলাম সাতক্ষীরার তালা উপজেলার শিরাগুনী দাখিল মাদরাসার সহকারী শিক্ষক (কম্পিউটার) হিসেবে কর্মরত আছেন। ভুয়া সনদ ব্যবহার করে গত ১২ বছর ধরে চাকরি করে সরকারি খাত থেকে বেতন-ভাতা বাবদ তিনি প্রায় ২৫ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন।


বিজ্ঞাপন


সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ভুয়া সনদে বছরের পর বছর ধরে চাকরি করা শিক্ষক শফিকুলের সনদ জালিয়াতির বিষয়টি আলোচনায় আসে এক বছর আগে। এ নিয়ে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এক নোটিশের মাধ্যমে বিষয়টি তদন্তের জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) প্রশান্ত কুমারের ওপর দায়িত্ব দেয় মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতর। যার প্রেক্ষিতে তদন্তভার অর্পিত হয় জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা প্রভাষ কুমারের ওপর। তদন্তের দায়িত্ব দেওয়ার সাত মাসেও তিনি তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারেননি বলেও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও সাবেক সাতক্ষীরা জেলা শিক্ষা অফিসার (এওডি) মিনরুল ইসলাম চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি জাল সনদের বিষয়ে তদন্তে শিরাশুনী দাখিল মাদরাসায় যান। বর্তমানে তিনি ঝিনাইদহ জেলার শিক্ষা অফিসার হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন।

ভুয়া সনদে চাকরির বিষয়ে খোঁজ নিয়েছে ঢাকা মেইল। কথা বলেছে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) সঙ্গেও। যেখানে সনদ জালিয়াতির বিষয়টি সামনে আসে। সেই সঙ্গে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে চাকরি করে আসা শফিকুল ইসলামের এনআইডি, এনটিআরসিএ (ভুয়া) সনদ, এনটিআরসিএ থেকে করা তদন্ত প্রতিবেদনও এসেছে ঢাকা মেইলের হাতে।

এসব কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়- শিরাশুনী দাখিল মাদরাসার সহকারী শিক্ষক (কম্পিউটার) মো. শফিকুল ইসলামের বাবার নাম জাহাবক্স সরদার। তিনি সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার শিরাশুনী গ্রামের বাসিন্দা। তার ইনডেক্স নম্বর- ২০৯৬৫৮৫ এবং এনআইডি নং- ৮৭১৯০৯৪৪৭২৯৬০। এছাড়া তার দেওয়া এনটিআসিএর সনদে রোল নম্বর- ৩১৮১৫৩৬০ ও রেজি. নম্বর- ৯০০০০১২৩/২০০৯ এবং এনটিআসিএ সনদের সিরিয়াল নম্বর- ৯২৫৪৬৮।

অনুসন্ধানে দেখা যায়- শফিকুল ইসলামের দেওয়া রোল নম্বর, রেজি নম্বর এবং সিরিয়াল কোনোটিই সঠিক নয়। তার ব্যবহৃত এনটিআরসিএ সনদটি ভুয়া। যেখানে তিনি নূপুর আক্তার নামে অন্য এক নারীর নম্বর ব্যবহার করেছেন।


বিজ্ঞাপন


Fake

এদিকে, বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) থেকে পাওয়া তথ্য মতে- শফিকুলের শিক্ষক নিবন্ধন সনদ যাচায়ে চলতি বছরের ৩০ মার্চ মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতর থেকে ৫৭.২৫.০০০০.০১০.১০.০০৭.২০.১১০০ নম্বরের একটি স্মারকে সাতক্ষীরার তালা উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর একটি চিঠি পাঠানো হয়। পরে ইউএনও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা প্রভাষকে বিষয়টি তদন্তের দায়িত্ব দেন। যে তদন্ত এখনও আলোর মুখ দেখেনি।

এরই মধ্যে এনটিআরসিএ থেকে গত ২৫ মে শফিকুল ইসলামকে শিক্ষক নিবন্ধন সনদের অনুলিপি এনটিআসিএ দফতরে পাঠাতে বলা হয়। যার প্রেক্ষিতে এনটিআরসিএ ৭ জুলাই ৩৭.০৫.০০০০.০১০.০৫.০০২.২০.৫৯৭ নম্বর স্মারকে শফিকুল ইসলামের সনদটি জাল/ভুয়া বলে জানিয়ে মাদরাসা সুপারকে চিঠি দেয়। একই দিনে অনলাইনে এনটিআরসিএ এর ‘সনদ যাচাই প্রতিবেদন’ প্রকাশও করে। যেখানে সনদ পর্যালোচনায়ও দেখা যায়- ভুয়া তথ্য দিয়ে চাকরি করে আসছেন অভিযুক্ত শফিকুল ইসলাম।

বিষয়টি নিয়ে কথা হলে শিরাগুনী দাখিল মাদরাসার সুপার সিরাজুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, শিক্ষক শফিকুল ইসলাম যে ভুয়া সনদ ব্যবহার করেছে আমাদের জানা ছিল না। তিনি যে সনদটি ব্যবহার করেন, এর সঙ্গে অরিজিনাল কাগজ-পত্রের কোনো মিল নেই। এনটিআরসিএ থেকে আমার কাছে কম্পিউটার শিক্ষকের সনদ চেয়ে চিঠি দেয়। পরে মাদরাসা থেকে কাগজপত্র আমি জমা দেই। যার প্রেক্ষিতে আমার কাছে নির্দেশ আসে তার বিরুদ্ধে মামলা করার।

তিন মাস আগে আমি এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পেরেছি উল্লেখ করে সিরাজুল ইসলাম বলেন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রশান্ত কুমারকে মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে জাল সনদ যাচায়ের জন্য তদন্তভার দেওয়া হয়। পরে উপজেলা নির্বাহী অফিসার উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা প্রভাষ স্যারকে তদন্তের দায়িত্ব প্রদান করেন।

মাদরাসা সুপার আরও বলেন, সাবেক সাতক্ষীরা সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার (এওডি) মিনরুল ইসলাম চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি শিরাশুনী দাখিল মাদরাসায় কম্পিউটার শিক্ষক শফিকুল ইসলামের জাল সনদের তদন্তে আসেন। কিন্তু শফিকুল ইসলাম মাদরাসা থেকে চলে যান এবং তাকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি মাদরাসায় এসে কাগজ দেখাতে রাজি হননি। ওই সময় তিনি ‘পরে দেখা করবেন’ বলে জানান।

এ নিয়ে শিক্ষক এলাকায় কিছুটা চাপে রয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি মাদরাসা সুপার হিসেবে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করছি। কাগজপত্র জোগাড় করে, থানায় অভিযোগ দাখিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’

তবে অভিযুক্ত মো. শফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অসত্য বলে দাবি করেন তিনি। তার সঙ্গে অন্যায় করা হচ্ছে জানিয়ে ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন মাদরাসা সুপার। তিনি নিজেও তো এখন সাসপেন্ড।’

বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) প্রতিবেদন নিয়ে শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এনটিআরসিএর ওয়েবসাইট ঠিক না। সেখানে দেওয়া অধিকাংশ তথ্য ভুল। এই ওয়েবসাইটে কিছুই পাওয়া যায় না। নূপুর আক্তার নামে কাউকেই চিনি না। আমার পরিচিত কেউ নন। ২০০৫ সাল থেকে ওয়েবসাইটে কিছুই নাই। কোনো তথ্যই নাই। আমার কাছে মনে হয়- তারা ভুলের মধ্যে আছে। আমি ঠিকই আছি।’ 

নিজের বক্তব্যের কোনো প্রমাণ আছে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি সঠিক আছি। প্রমাণ থাকুক আর নাই থাকুক। আমার একটাই বক্তব্য সুপার সিরাজুল ইসলামই আমার বিরুদ্ধে এসব করাচ্ছেন। সুপার আমাকে হয়রানি করছে বিভিন্ন কায়দায়। স্থানীয় সাংবাদিক দিয়েও আমাকে হয়রানি করা হয়েছে। মিথ্যা হয়রানির শিকার করা হচ্ছে। আমি হয়রানির শিকার।’

Fake

এ বিষয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আতিয়ার রহমানের সঙ্গে কথা হলে ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘তার (শিক্ষক শফিকুল ইসলাম) সনদে সমস্যা আছে। এখন মূল সমস্যা হলো- ওখানে তো কমিটি-টমিটি নেই পদক্ষেপ নেবে কে? আমি শুনেছি এনটিআরসিএ না কি ব্যবস্থা নিতে বলেছে মাদরাসা সুপারকে। যেহেতু সুপারকে মামলা করতে বলা হয়েছে, তিনি করবেন। তারাই ব্যবস্থা নেবেন। এ বিষয়ে আমার আর কোনো মন্তব্য নেই। যদি ভুয়া হয়, তাহলে চাকরি থাকবে না।’

এদিকে, সাতক্ষীরা জেলা সাবেক শিক্ষা কর্মকর্তা (এওডি) মিনরুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে জানিয়েছেন, একসময় সাতক্ষীরা জেলায় কর্মরত ছিলেন তিনি। বর্তমানে ঝিনাইদহে আছেন। ভুয়া সনদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি তদন্ত করে অফিসে জমা দিয়ে দিয়েছি। এখন ঠিক স্পষ্ট করে বলা কঠিন। ঠিক কি রিপোর্ট জমা দিয়েছি, তা মনে করতে পারছি না। অফিস থেকে যদি আমাকে নির্দেশনা দেয়, তাহলে বলতে পারব। নিয়ম অনুযায়ী- সদন যাচাই না করে তার চাকরি হওয়ার কথা না। তাহলে কি করে উনি চাকরিতে যোগ দিলেন বা কাদের যোগসাজশ ছিল- তাও দেখার বিষয় রয়েছে।’

এ বিষয়ে মাদরাসা অধিদফতর থেকে তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া ইউএনও নির্বাহী অফিসার প্রশান্ত কুমারকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এছাড়া ইউএনও’র নির্দেশনায় তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া শিক্ষা কর্মকর্তা প্রভাষ কুমারের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে গড়িমসির যে অভিযোগ রয়েছে। তা নিয়ে জানতে একাধিকবার ফোনে দিলেও কল রিসিভ না করায় তার বক্তব্যও পাওয়া যায়নি।

বিষয়টিতে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) সহকারী পরিচালক তায়জুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের কাছে একটা অভিযোগ এসেছে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা জবাব দিয়েছি। চিঠি পাঠিয়েছি। প্রতিষ্ঠান প্রধানকে জানিয়েছি। যেখানে আমরা পেয়েছি সনদটি সঠিক নয়, জাল।’

অভিযুক্ত শিক্ষকের তোলা বেতন-ভাতা ফেরত দেওয়া কিংবা তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে কি না- এমন প্রশ্নে তায়জুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান প্রধানকে বলা হয়েছে মামলা করতে। তার বেতন-ভাতা ফেরত দেওয়া আমাদের বিষয় না, এটা মামলার পরবর্তী বিষয়। এমন সিদ্ধান্ত আমরা করতে পারব না। মামলা হবে, মামলার পর পরবর্তীতে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ডিএইচডি/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর