রোববার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ইবিতে সুকৌশলে শিক্ষার্থীদের মাঠে নামাচ্ছে ফ্যাসিবাদীরা

রাকিব রিফাত, ইবি
প্রকাশিত: ০২ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:৩০ পিএম

শেয়ার করুন:

ইবিতে সুকৌশলে শিক্ষার্থীদের মাঠে নামাচ্ছে ফ্যাসিবাদীরা

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) জুলাই অভ্যুত্থানবিরোধী ভূমিকায় থাকা ৩০ জন শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সম্প্রতি সাময়িক বরখাস্ত এবং ৩৩ জন ছাত্রলীগ নেতাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন।

এর মধ্যে ১৯ জন সিনিয়র ও জুনিয়র শিক্ষক রয়েছেন। অভিযোগ আছে, এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন তাদের গডফাদাররা। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এরা জামাত ও বিএনপির ছত্রছায়ায় বেঁচে গেছে।


বিজ্ঞাপন


জুলাই পক্ষের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, যারা ৫ আগস্টের আগে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্যে ও গোপনে ফ্যাসিবাদ কায়েম করার চেষ্টা করেছিলেন, তারা অনেকেই ছুটি নিয়ে দেশের বাইরে যাচ্ছেন অথবা দীর্ঘমেয়াদি ছুটির প্রক্রিয়া গ্রহণ করছেন। তারা কোনোভাবেই ফ্যাসিবাদের গডফাদারদের পালাতে দেবেন না এবং প্রশাসন যেন কাউকে সেফ এক্সিট না দেয়, এ দাবি রাখছেন।

অন্যদিকে, যেসব ফ্যাসিস্টকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে তাদের বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে একটি মহল। সূত্র বলছে, ফ্যাসিবাদীরা সুকৌশলে কিছু সিনিয়র ও নবীন শিক্ষার্থীকে ব্যবহার করে দলের সুবিধাভোগীদের রক্ষা করতে মাঠে নামাচ্ছে। তারা বিভাগের নামে শিক্ষার্থীকে বিভ্রান্ত করে আন্দোলনে নামাতে চাচ্ছে।

জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ বিভাগই এখন ফ্যাসিবাদপ্রবণ দলের প্রভাবাধীন বলে অভিযোগ উঠছে। বরখাস্ত শিক্ষকদের ঘনিষ্ঠ ছাত্রদের দ্বারা জুনিয়রদের বিভিন্নভাবে প্ররোচিত করে আন্দোলনে নামানোর চেষ্টা এবং স্বাক্ষর সংগ্রহ করার ঘটনাও কয়েকটি বিভাগে রিপোর্ট করা হয়েছে। পাশাপাশি মহলটি বিভিন্ন ইস্যু ব্যবহার করে ক্যাম্পাসে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

গত ১৫ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চার্জশিটভিত্তিক শনাক্তকরণের জন্য পাঁচ সদস্যের তদন্তকমিটি গঠন করে। প্রত্যক্ষদর্শীদের লিখিত ও মৌখিক অভিযোগ, বিভিন্ন তথ্যচিত্র, ভিডিও ও সংবাদ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কমিটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জুলাই-আগস্ট বিপ্লববিরোধী ও নিরুৎসাহক কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত থাকার অনুসন্ধান চালায়। কমিটির প্রতিবেদন জমা হলে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। সর্বশেষ কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গত ৩০ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭১তম সিন্ডিকেট সভায় অভিযুক্তদের শাস্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্তে ৩০ শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত এবং ৩৩ ছাত্রলীগ নেতাকে বহিষ্কার ও সনদ বাতিল করার কথা বলা হয়েছে।


বিজ্ঞাপন


আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহজাহান মন্ডল ও অধ্যাপক ড. রেবা মন্ডলের বিরুদ্ধে নেওয়া বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার চেয়ে শনিবার (১ নভেম্বর) বিভাগীয় শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান করেন। একই সঙ্গে মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক মাজেদুল ইসলাম নয়ন ও হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষক শহিদুল ইসলামেরও বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবি নিয়ে বিভাগ দুটি (২ নভেম্বর) মানববন্ধন করে। অভিযোগ আছে, আওয়ামী ফ্যাসিস্ট নামধারী এক ছাত্রলীগ কর্মী সজিব মানববন্ধনের নেতৃত্ব দেন; তার বিরুদ্ধে মাদক, সাংবাদিকের ফোন কেড়ে নেওয়া, জুলাই আন্দোলনের বিরুদ্ধচারণাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।

তবে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার চাওয়া শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, তারা জুলাই আন্দোলন চলাকালীন আওয়ামীপন্থী শিক্ষক সংগঠন শাপলা ফোরামের আয়োজিত র‍্যালি ও সমাবেশেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। ওই র‍্যালিতে জুলাই আন্দোলনকে নৈরাজ্য বলে আখ্যায়িত করে ও শেখ হাসিনার প্রতি অগাধ বিশ্বস্ততার স্লোগানও উচ্চারণ করা হয়েছিল।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, কেউ কেউ দীর্ঘ ছুটি নিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে চাচ্ছেন; তাদের যেন প্রশ্রয় না দেওয়া হয়। তাদের দাবি, সাবেক ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারারসহ শাপলা ফোরাম ও বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতারা ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন, কেউ প্রকাশ্যে, কেউ গোপনে। তারা দুর্নীতি, নিয়োগবানিজ্য, নারী নিপীড়ন ও অপছন্দের শিক্ষার্থীদের ফেল করে দেয়া–সহ বহু অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। প্রশাসন যদি এই ফ্যাসিস্টদের বিষয়ে ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে—এ মন্তব্যও করেছেন ছাত্ররা।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাবেক সহ-সমন্বয়ক ইয়াশিরুল কবির সৌরভ বলেন, জুলাই আন্দোলনকে প্রতিহত করতে শিক্ষকদের নির্দেশে হল বন্ধের চেষ্টা করা হয়েছিল, আন্দোলনকারীদের জঙ্গি আখ্যা দেয়া হয়েছিল এবং জোর করে স্বাক্ষর নিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের চেষ্টা করা হয়েছিল। প্রশাসন দ্বারা হামলার নকশা তৈরির অভিযোগও ছিল। আন্দোলনকারীদের বারবার হুমকি দেয়া হয়েছিল। আওয়ামীপন্থী শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের প্রতি প্রতিহত হলে কড়া ভাষায় মিছিল করতেন—এমন কথাও তিনি উল্লেখ করেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক এস. এম. সুইট মন্তব্য করেন, কাউকে সেফ এক্সিট দেয়ার চেষ্টা হলে ইবির ছাত্র সমাজ তা রুখে দেবে।

ইবি ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম রাশেদ এক ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তগুলো পরিকল্পিত ও ষড়যন্ত্রমূলক পদক্ষেপ। তিনি আরও দাবি করেছেন, ফ্যাসিস্ট ভিসি, প্রো-ভিসি ও প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের যারা ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিলেন, তাদের অনেকের নাম শাস্তিপ্রাপ্ত তালিকায় নেই। ৪ আগস্ট ২০২৪-এর আন্দোলনবিরোধী মিছিলে অংশ নেওয়া বহু শিক্ষক-কর্মকর্তার নামও তালিকা থেকে বাদ আছে। দুর্নীতির বিনিময়ে নাম বাদ হওয়া, হামলা-মামলার নির্দেশদাতাদের প্রোমোশন পাওয়া—এসব ঘটনাকে তিনি তীব্রভাবে নিন্দা করেছেন।

বিএনপিপন্থী শিক্ষক সংগঠন ইউট্যাব ইবি শাখার সভাপতি অধ্যাপক ড. তোজাম্মেল হোসেন বলেন, যারা জুলাই বিপ্লবকে ব্যাহত করার ষড়যন্ত্র করেছে এবং আন্দোলনকারীদের হুমকি দিয়েছে তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। একই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে যে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যেন শাস্তি না পায়। তিনি উল্লেখ করেন, প্রত্যেক বিভাগে কিছু শিক্ষকের ঘনিষ্ঠ শিক্ষার্থী থাকেন, যারা শিক্ষককে সমর্থন দিয়ে অনৈতিক কাজও প্রশ্রয় দেয়; এসব ঘটনাও বিষয়টির অংশ।

ইবি’র ভিসি প্রফেসর ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বিরোধী বিতর্কিত ভূমিকার জন্য শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে আরও একটি কমিটি গঠন করা হবে, সেই কমিটি বিচার করে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের কতটুকু শাস্তি দেওয়া হবে তা নির্ধারণ করবে। তবে ফ্যাসিস্টদের বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না—এই প্রতিশ্রুতি তিনি ব্যক্ত করেন।

এআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর