মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাঁকা থাকতে পারে ৪ লাখের বেশি আসন

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ০১:৪৫ পিএম

শেয়ার করুন:

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাঁকা থাকতে পারে ৪ লাখের বেশি আসন
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাঁকা থাকতে পারে ৪ লাখের বেশি আসন

চলতি বছর এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় পাসের হার গত ২১ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। এর সরাসরি প্রভাব পড়তে যাচ্ছে দেশের সর্ববৃহৎ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৫–২৬ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়টির অধিভুক্ত কলেজগুলোতে চার লাখের বেশি আসন ফাঁকা থাকতে পারে। শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাসের হার কমে যাওয়ার কারণে উচ্চশিক্ষার চাহিদা যেমন কমছে, তেমনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এখন এক কঠিন ভর্তি সংকট ও আর্থিক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।

শিক্ষা বোর্ডগুলোর তথ্য অনুযায়ী, এ বছর এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নেয় ১২ লাখ ৫১ হাজার ১১১ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে মাত্র ৭ লাখ ২৬ হাজার ৯৬০ জন, যা গত দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম। জিপিএ–৫ পেয়েছেন ৬৯ হাজার ৯৭ জন, আর জিপিএ–৪ ও ৩.৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা যথাক্রমে ১ লাখ ৫৯ হাজার ও ১ লাখ ৩৯ হাজার। ফলে দেশের উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে ভর্তি-যোগ্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা আগের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।


বিজ্ঞাপন


ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি ও বেসরকারি কলেজগুলোতে স্নাতক (পাস), সম্মান, কারিগরি ও সমমান পর্যায়ে মোট আসন রয়েছে প্রায় ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৯৫টি। এর মধ্যে ২০২৩–২৪ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছিল ৭ লাখ ৪ হাজার ১৯৬ জন শিক্ষার্থী। অর্থাৎ প্রায় ১ লাখ ৯৭ হাজার আসন তখনই শূন্য ছিল। তার আগের বছর, অর্থাৎ ২০২১ সালে ১০ লাখ ৯ হাজার ৭৯১টি আসনের বিপরীতে ভর্তি হয়েছিল মাত্র ৬ লাখ ১৩ হাজার ১৩৩ জন, ফলে তখন ফাঁকা ছিল প্রায় ৪ লাখ আসন। এ বছর পাসের হার আরও কমে যাওয়ায় আসন শূন্যতার সংখ্যা যে আবারও ৪ লাখ ছাড়িয়ে যাবে, তা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রমের সময়সূচি নিয়েও শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। আগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি শুরু হতো। ফলে যারা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারত না, তারা এখানে ভর্তি হতো। কিন্তু এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ই আগে ভর্তি শুরু করছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা বিভ্রান্তিতে পড়ছে, তারা আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে, না কি পাবলিক বা গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করবে। অনেক শিক্ষার্থী প্রথমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পরে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেলে চলে যাচ্ছে, এতে তাদের অর্থনৈতিক ক্ষতিও হচ্ছে।

ভর্তি-প্রত্যাশী সাবিকুন্নাহার ফারিহা বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ডিসেম্বরেই ভর্তি নিচ্ছে, অথচ গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা মার্চে। আমরা এখন দ্বিধায়, সেশনজট এড়াতে আগে ভর্তি হব, না কি অপেক্ষা করব। এতে দুই জায়গায় ভর্তি ফি দিতে হচ্ছে, পরিবারও বিপদে পড়ছে। 

তিনি আরও বলেন, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি সময় যদি একসাথে নির্ধারণ করা হয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।


বিজ্ঞাপন


জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম আমানুল্লাহ জানিয়েছেন, এ বছর বিশ্ববিদ্যালয়টির আর্থিক ক্ষতি হতে পারে সবচেয়ে বেশি। কারণ, দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় অংশ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়, যেখানে প্রতি বছর লাখো শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। এবার পাসের হার কমে যাওয়ায় ভর্তি-যোগ্য শিক্ষার্থীও কমে গেছে, এর সরাসরি প্রভাব পড়বে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজস্ব আয়েও।

তিনি বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কোনো সরকারি বাজেট বা রাজস্ব উৎস নেই। শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি, টিউশন ফি ও অন্যান্য ফি দিয়েই আমাদের প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ভর্তি কমে গেলে রাজস্বও কমে যাবে, এতে আর্থিকভাবে আমরা বড় সংকটে পড়ব।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, যাচাই-বাছাই ছাড়া কলেজ অনুমোদন দেওয়া এবং পরিকল্পনাহীনভাবে আসন বাড়ানোর কারণেই এই সংকট আরও প্রকট হয়েছে। দেশের অনেক কলেজেই শিক্ষার্থী কম, অথচ আসন বাড়ানো হয়েছে। এতে ভর্তি সংখ্যা না বাড়লেও শূন্য আসন বেড়েছে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক অধ্যাপক বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছরই কয়েক লাখ আসন ফাঁকা থাকে। অথচ নতুন কলেজ অনুমোদন ও আসন বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত। পরিকল্পনা ছাড়া আসন বাড়ানো মানে হচ্ছে উচ্চশিক্ষার কাঠামোকে আরও অস্থিতিশীল করে তোলা।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় আড়াই হাজার কলেজে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু এ বছর এইচএসসিতে কম পাসের কারণে অনেক কলেজে ভর্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এমনও আশঙ্কা করা হচ্ছে, কিছু কলেজে হয়তো একজন শিক্ষার্থীও ভর্তি হবে না। এটি শুধু শিক্ষা সংকট নয়, বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যারও ইঙ্গিত দিচ্ছে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, যদি দ্রুত ভর্তি সময়সূচি, আসন পুনর্বিন্যাস ও কলেজ অনুমোদনের বিষয়ে সমন্বিত পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে আগামী বছরগুলোতে এ সংকট আরও গভীর হবে। দেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয় এখন যে সংকটের মুখে, তা কেবল ভর্তি ঘাটতি নয়, এটি দেশের উচ্চশিক্ষা কাঠামোর স্থায়িত্ব নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।

এম/এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর