রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনের ভোটগ্রহণ ঘিরে শেষ সময়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। সকাল থেকেই শান্তিপূর্ণভাবে ভোট চললেও দুপুরের পর পরিস্থিতি কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ছাত্রদল ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অভিযোগের ঘটনায়। উভয় সংগঠনই একে অপরের বিরুদ্ধে নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছে।
নির্বাচনকে ঘিরে এমন উত্তেজনার প্রেক্ষিতে ভোটকেন্দ্রগুলোতে অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হয়। পুলিশের পাশাপাশি আনসার সদস্যরাও মাঠে অবস্থান নেন। নির্বাচন কমিশন জানায়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ক্যাম্পাসের সংবেদনশীল কেন্দ্রগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে এবং সিসিটিভি ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
ছাত্রদল অভিযোগ করেছে, সকাল থেকেই তাদের প্রার্থীদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়েছে।অথচ শিবির সমর্থিত প্রার্থীরা প্রবেশ করেছে। অন্যদিকে ছাত্রশিবিরের দাবি, ছাত্রদলের প্রার্থীরা প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে ভোট প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ঘটাচ্ছে এবং তাদের হেনস্তা করছে।
সকালে ভোটের শুরুতেই সিরাজী ভবনের সামনে চিরকুট নিয়ে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) পদপ্রার্থী মোস্তাকুর রহমান জাহিদ। তিনি বলেন, “নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো চিরকুট নিয়ে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করা যাবে। কিন্তু বাস্তবে একাধিক স্থানে আমাদের সমর্থকদের প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়েছে। ১০০ গজের ভেতরে কারও যাওয়ার অনুমতি ছিল না, অথচ ঐক্য প্যানেলের অনেকে সেখানে ঘুরে বেড়িয়েছে এবং চিরকুট বিতরণ করেছে।
মোস্তাকুর রহমান বলেন, ছাত্রদল নিয়ম তোয়াক্কা না করে খালেদা জিয়া হল ও হবিবুর রহমান হলের পাশে বুথ স্থাপন করেছে। অথচ বুথ স্থাপনের কোনো অনুমতি ছিল না। বহিরাগত ছাত্রদল, যুবদল ও বিএনপির অনেকেই ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছে। তাদের মধ্যে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকসহ অনেকে রয়েছেন। এরা কেউ ভোটার বা প্রার্থী নন, তবুও তারা ভোটকেন্দ্রে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
বিজ্ঞাপন
মোস্তাকুর রহমান জাহিদ অভিযোগ করে বলেন, ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ক্যাম্পাসে বসে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছেন—বলেন, জামায়াত অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বা বাইরে থেকে লোক ঢুকাচ্ছে। অথচ তিনি নিজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নন, ভোটারও নন। তিনি গুজব ছড়িয়ে রাকসুর পরিবেশ অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছেন।
মোস্তাকুর রহমান বলেন, গতকাল নিয়ম ভেঙে দেয়ালে লেখনি করা হয়েছে। কিন্তু প্রশাসন এ বিষয়ে নীরব ভূমিকা পালন করছে। যারা নির্বাচনের নিয়মনীতি ভঙ্গ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। চারবার নির্বাচন পিছিয়ে অবশেষে আজ ভোট হচ্ছে। আমি সবাইকে আহ্বান জানাই—আপনারা যেন যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেন।
রাকসু নির্বাচনে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন ছাত্রদল মনোনীত ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) পদপ্রার্থী শেখ নুর উদ্দিন আবির। তিনি বলেন, “দীর্ঘ এক ঘণ্টা ধরে ভোটগ্রহণ বন্ধ রেখে পোলিং অফিসার নিজ হাতে সিগনেচার করে ব্যালট পেপারে ভোট দিচ্ছেন এবং তা ব্যালট বক্সে ফেলছেন। অথচ নিয়ম অনুযায়ী একজন অফিসার ১৫–২০টি ব্যালটে সিগনেচার করতে পারেন, কিন্তু তারা নিজেরাই বিপুল পরিমাণ ব্যালটে ভোট দিচ্ছেন।
শেখ নুর উদ্দিন আবির আরও অভিযোগ করেন, বিএনসিসি ও রোভার স্কাউটের কিছু সদস্য নির্বাচনী কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে শিবির-সমর্থিত প্রার্থী ও ভোটারদের প্রবেশের সুযোগ দিচ্ছেন। অথচ আমি নিজে ভিপি প্রার্থী হয়েও ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারিনি। এটি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।আবির বলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনে যদি এমন পক্ষপাতমূলক আচরণ হয়, তবে শিক্ষার্থীদের গণতন্ত্রে আস্থা নষ্ট হবে। আমি নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করছি—অবিলম্বে অনিয়ম তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা পায়।
এদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা কাজ করছে পরিস্থিতি নিয়ে। কেউ কেউ ভোটের পরিবেশ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তবে বিকেলের পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসে এবং ভোটগ্রহণ কার্যক্রম চলতে থাকে নির্বিঘ্নে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। যেকোনো ধরনের বিশৃঙ্খল কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এমন পাল্টাপাল্টি অভিযোগে উত্তপ্ত হলেও সামগ্রিকভাবে ক্যাম্পাসে ভোটের উৎসবমুখর আমেজ বজায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন উপস্থিত শিক্ষার্থীরা।
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রাকশু নির্বাচনের দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী একটি বাগানের ভিতরে কিছু লোকের অস্বচ্ছ ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে। ভিডিওতে দাবি করা হয়েছে, একটি রাজনৈতিক দলের লোক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটের বিপরীত পাশে প্রকাশ্যে অস্ত্র বিতরণ করছে।
পুলিশের তদন্তে দেখা গেছে, বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। ভিডিওতে ধরা পড়েছে, বিভিন্ন দলের সমর্থক ও স্থানীয় উৎসুক লোকজন বাগানের পায়ে হাঁটা পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে, গাছের ছায়ায় আড্ডা দিচ্ছে এবং খাওয়া দাওয়া করছে। ঘটনাস্থলের খুব নিকটে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি সদস্যরা অবস্থান করছেন। এ ধরনের প্রকাশ্য স্থানে কোনোভাবেই অস্ত্র বিতরণ সম্ভব নয়।
আরএমপি আরও জানিয়েছে, দূর থেকে ধারণ করা ভিডিওর মাধ্যমে সাধারণ আড্ডা ও খাওয়া-দাওয়া দৃশ্যকে অস্ত্র বিতরণের নামে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি ও আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে।
পুলিশ সবাইকে অনুরোধ করেছে গুজব ছড়ানো, মিথ্যা তথ্য প্রচার, শেয়ার করা, লাইক বা কমেন্ট থেকে বিরত থাকতে। মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর পোস্ট করা ফৌজদারি অপরাধ এবং রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
এএইচ/ক.ম

