শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

চবি শিক্ষার্থীদের রক্তে ভিজল জোবরা গ্রাম, আহত শতাধিক, ১৪৪ ধারা জারি

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:৪২ এএম

শেয়ার করুন:

চবি শিক্ষার্থীদের রক্তে ভিজল জোবরা গ্রাম, আহত শতাধিক, ১৪৪ ধারা জারি
চবি শিক্ষার্থীদের রক্তে ভিজল জোবরা গ্রাম, আহত শতাধিক, ১৪৪ ধারা জারি

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) এবং এর পার্শ্ববর্তী জোবরা গ্রামে শিক্ষার্থীদের ওপর সংঘবদ্ধ হামলায় রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে পুরো এলাকা। গত শনিবার (৩০ আগস্ট) রাত থেকে রোববার (৩১ আগস্ট) বিকেল পর্যন্ত টানা দফায় দফায় চলা এই সহিংসতায় আহত হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষার্থী, দুইজন উপ-উপাচার্য, প্রক্টর ও নিরাপত্তা শাখার একাধিক সদস্য। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন। সহিংসতা ঠেকাতে অভিযান শুরু করেছে সেনাবাহিনী।

ঘটনার সূত্রপাত শনিবার রাত ১১টার দিকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট সংলগ্ন এলাকার একটি ভবনে ভাড়াটিয়া শিক্ষার্থী সুফিয়া খাতুন রাত ১১টার পর বাসায় ফিরে গেট বন্ধ পান। অভিযোগ অনুযায়ী, ওই ভবনের স্থানীয় দারোয়ান তাকে প্রায় এক ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখেন এবং পরবর্তীতে দরজা খুলে তাকে মারধর করেন। সুফিয়া খাতুন বলেন, দারোয়ান তাকে উদ্দেশ্য করে কটূক্তি করেন, থাপ্পড়, লাথি মারেন এবং জোর করে ভেতরে ঢুকতে চাইলে আবারও আঘাত করেন। তিনি তার সহপাঠীদের ডেকে বিষয়টি জানান। এরপর তারা ঘটনাস্থলে গেলে উত্তেজনা তৈরি হয়।


বিজ্ঞাপন


ছাত্রীরা প্রতিবাদ জানাতে গেলে হঠাৎ করে আশপাশের ভবন ও মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হামলা করতে এসেছে, সবাই দা, কিরিচ নিয়ে বের হন। এই ঘোষণার পরপরই জোবরা গ্রামের কয়েকশ’ মানুষ দলবদ্ধ হয়ে ছাত্রদের মেস ও আবাসিক ভবনে হামলা চালায়। তারা শিক্ষার্থীদের ওপর ধারালো অস্ত্র, ইট-পাটকেল নিয়ে হামলে পড়ে। অনেক ছাত্রকে ছাদে তুলে নির্মমভাবে পেটানো হয়, এমনকি কয়েকজনকে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। হামলায় আহত অধিকাংশ শিক্ষার্থীর শরীরে ধারালো অস্ত্রের কোপের চিহ্ন রয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে অন্তত ৫০ জনকে, যাদের অনেকেই আইসিইউতে রয়েছেন।

এ সময় হামলা ঠেকাতে গেলে আহত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন, উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক ড. শামীম উদ্দিন খান, প্রক্টর অধ্যাপক ড. তানভীর হায়দার আরিফ এবং নিরাপত্তা বিভাগের প্রধানসহ আরও অনেকে। স্থানীয়রা এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক গাড়িসহ বেশ কয়েকটি গাড়ি ও ভবনে ভাঙচুর চালায়।

চবি সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. মো. টিপু সুলতান জানিয়েছেন, আহত শিক্ষার্থীর সংখ্যা শতাধিক ছাড়িয়ে গেছে। অনেকের শরীরের বিভিন্ন অংশে গভীর কোপ রয়েছে। ৪০ জনের বেশি শিক্ষার্থীকে সেলাই দিতে হয়েছে, যাদের অনেকে গুরুতর অবস্থায় রয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, হামলার নেতৃত্ব দিয়েছে স্থানীয় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ। তাদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে জোবরা এলাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের প্রভাব রয়েছে, যারা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক টেন্ডার, পরিবহন ও বাণিজ্যিক স্বার্থে শিক্ষার্থীদের দমন করতে চায়। এসব নেতাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সন্ত্রাসীরা পরিকল্পিতভাবে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। ঘটনার রাতে তারা হেলমেট পরে, হাতে রামদা ও কিরিচ নিয়ে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে আঘাত করে।


বিজ্ঞাপন


অন্যদিকে স্থানীয় এক বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে এ ঘটনায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগ উঠে। পরে বিএনপির পক্ষ থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য উদয় কুসুম বড়ুয়াকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এর আগে গত বছরও একই নেতার মদদে শিক্ষার্থীদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার অভিযোগ ছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, এটি কোনো হঠাৎ সংঘর্ষ নয়, এটি ছিল পরিকল্পিত গণহত্যার চেষ্টা। ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত নেতারা হেলমেট পরে শিক্ষার্থীদের কুপিয়েছে। স্থানীয় সন্ত্রাসী চক্রের সঙ্গে তাদের সখ্য রয়েছে। আমাদের বারবার জানানো সত্ত্বেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে তৎপরতা ছিল না।

হামলার পর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায়। অনেক শিক্ষার্থী মেস ও বাসা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটতে থাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা গেছে, কীভাবে শিক্ষার্থীদের ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে বা চোখে আলো ফেলে কুপিয়ে আহত করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই একে চবির ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রোববার দুপুরে হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় ও সংলগ্ন এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। রোববার সন্ধ্যায় সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে অভিযান শুরু করে বলে জানা গেছে। সেনা সদস্যরা শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের নিরাপত্তা দিতে বিভিন্ন ভবন, মেস ও দোকান এলাকায় টহল শুরু করে।

উল্লেখ্য, এই জোবরা গ্রাম পূর্বেও চবি শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত ছিল। ২০১০ সালে অ্যাকাউন্টিং বিভাগের ছাত্র আসাদুজ্জামানকে খুন করে জোবরা এলাকার সন্ত্রাসীরা। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ও ২১ অক্টোবরেও একই ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেছিল, যেখানে গুলি, ককটেল বিস্ফোরণ ও ছোড়ার আঘাতে শিক্ষার্থীরা গুরুতর আহত হয়।

এদিকে সংঘর্ষের কারণে রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করছে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো গ্রেফতার বা বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, অতীতেও হামলার বিচার হয়নি, এবারও যদি অপরাধীদের শাস্তি না হয়, তাহলে এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে।

এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর