ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি মানেই আন্দোলনের ইতিহাস, গৌরবের স্মৃতি আর নানা বিতর্কে ভরা অতীত। সেই রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুই বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু। দীর্ঘদিনের নীরবতার পর আবারও আলোচনায় এসেছে এই নির্বাচন। শিক্ষার্থীরা এখন আর শুধু ব্যালটের ফলাফলের দিকে তাকিয়ে নেই; তারা ভাবছে—এই প্যানেলগুলো সত্যিই কি তাদের স্বার্থে কাজ করবে?
মঙ্গলবার সকাল। টিএসসির সামনে ভাজা মুড়ির থালা, সিগারেটের ধোঁয়া আর প্রাণবন্ত আড্ডায় মেতে কয়েকজন শিক্ষার্থী। কেউ বললেন, প্যানেল তো আসবেই, কিন্তু তারা আমাদের দৈনন্দিন সমস্যাগুলো সমাধান করবে কি না, সেটাই আসল।
বিজ্ঞাপন
কলাভবনের সামনে ফুটপাতের চায়ের দোকানেও একই আলোচনা। বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বললেন, ডাকসুতে সব পক্ষের প্রতিনিধিত্ব থাকা দরকার। পূর্ণাঙ্গ প্যানেল অন্তত অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ তৈরি করতে পারে। তবে বাস্তবে তারা কতটা কাজ করবে, সেটাই দেখার বিষয়। তাঁর মতে, ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা, ক্লাসরুমে আসনের সংকট, কিংবা সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া কার্যক্রম—সবখানেই ডাকসুর সক্রিয় ভূমিকা দরকার।
আরও পড়ুন: ডাকসু নির্বাচন ঘিরে সরগরম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা যায়, ডাকসু নির্বাচনের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি কোণে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত টিএসসির চত্বর যেন আলোচনার কেন্দ্র। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আড্ডার ফাঁকে কেউ ডাক শুনে অন্য আড্ডায় যোগ দিচ্ছেন, কোথাও উচ্ছ্বাস, কোথাও তর্ক-বিতর্ক। ক্যান্টিন থেকে ভেসে আসা হাসি-ঠাট্টার শব্দও শেষ পর্যন্ত গিয়ে থামে একই জায়গায়—ডাকসু নির্বাচন। অনুষদ ভবনের বারান্দা, ছায়াঘেরা প্রাঙ্গণ কিংবা লাইব্রেরির সিঁড়ি—সবখানেই শিক্ষার্থীরা ছোট ছোট দলে জটলা করছেন। আলোচনার বিষয় একটাই—ভোট ও প্রার্থীরা।
এই উচ্ছ্বাসের ভেতরেই চলছে প্রার্থীদের দৌড়ঝাঁপ। মনোনয়নপত্র সংগ্রহের শেষ দিনেও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করতে পারেনি। সংগঠনটি কেবল ভিপি পদে তিনজনসহ কয়েকটি পদে ফরম তুলেছে। তবে কারা কোন পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। ছাত্রদল নেতাদের দাবি, চূড়ান্ত প্যানেল নির্ধারণ করবেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ভিপি পদে ফরম তুলেছেন কেন্দ্রীয় কমিটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মমিনুল ইসলাম জিসান, বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বি এম কাউসার এবং আবিদুল ইসলাম খান। সাধারণ সম্পাদক, সহ-সাধারণ সম্পাদক ও তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক পদেও ফরম তোলা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
অন্যদিকে ইসলামী ছাত্রশিবির ঘোষণা করেছে ২৮ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ প্যানেল। এই প্যানেলে দলীয় নেতাদের পাশাপাশি জায়গা পেয়েছেন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত শিক্ষার্থী, এমনকি আপ বাংলাদেশ ও ইনকিলাব মঞ্চের প্রতিনিধিরাও। শীর্ষ তিন পদে রয়েছেন—ভিপি আবু সাদিক কায়েম, সাধারণ সম্পাদক এস এম ফরহাদ এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন খান।
বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতৃত্বে গঠিত ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ও তাদের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে। এই প্যানেলে ভিপি পদে রয়েছেন শেখ তাসনিম আফরোজ, সাধারণ সম্পাদক মেঘমল্লার বসু এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন জাবির আহমেদ জুবেল।
‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’ থেকে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ (বাগছাস) অংশ নিচ্ছে নির্বাচনে, তবে তাদের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা এখনও প্রকাশ হয়নি। বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ ঘোষণা করেছে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল; যেখানে ভিপি পদে রয়েছেন বিন ইয়ামিন মোল্লা, জিএস পদে সাবিনা ইয়াসমিন এবং এজিএস পদে রাকিবুল ইসলাম।
এবার স্বতন্ত্র প্যানেলও দেখা যাচ্ছে। উমামা ফাতেমার নেতৃত্বে একটি পূর্ণাঙ্গ দল ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। ভিপি পদে থাকছেন উমামা ফাতেমা নিজে, জিএস পদে আল সাদী ভূইয়া এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক পদে মহিউদ্দিন মুজাহিদ মাহী।
আরও পড়ুন: হাসিনাকে আজীবন সদস্য চাওয়া ইমি ডাকসুতে বামজোটের ভিপি প্রার্থী!
তাছাড়া এনসিপির বহিষ্কৃত যুগ্ম সদস্য সচিব মাহিন সরকারও নতুন করে সংগঠন গুছানোর চেষ্টা করছেন। তাঁর সমর্থনে ভিপি পদে থাকতে পারেন স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংসদের আহ্বায়ক জামালুদ্দীন মুহাম্মদ খালিদ, জিএস পদে মাহিন সরকার এবং এজিএস পদে ফাতেহা শারমিন এ্যানি।
সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের আলোচনায় সবচেয়ে বেশি জায়গা পাচ্ছে বিভিন্ন প্যানেল। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্রশিবির, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ, বামপন্থী ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’, স্বতন্ত্র প্রার্থী উমামা ফাতেমার প্যানেল এবং বহিষ্কৃত এনসিপি নেতা মাহিন সরকারের সমর্থিত প্রার্থীরা—সবাইই নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে ব্যস্ত। প্রতিটি প্যানেলই দাবি করছে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করার, যদিও শিক্ষার্থীদের মনে এখনও রয়ে গেছে সংশয়।
ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা বলছেন, দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর এই নির্বাচন তাদের মধ্যে নতুন এক উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করেছে। উর্দু বিভাগের শিক্ষার্থী প্রথা মনে করেন, নতুন ধারণা নিয়ে আসা প্রার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। জনপ্রশাসন বিভাগের মাস্টার্স শিক্ষার্থী তানজিম ইসলাম বলেন, নেতৃত্ব শুধু একাডেমিক নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও প্রতিফলিত হওয়া দরকার। ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের আবু রায়হান মনে করেন, ছাত্রশিবিরের সক্রিয়তা ও সহযোগিতার মনোভাব শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করছে। অন্যদিকে সাদিয়া আফরিন মিতুর মতে, দলীয় পরিচয় নয়, বরং শিক্ষার্থীদের যৌথ অংশগ্রহণ আর সৃজনশীল উদ্যোগই শিক্ষাঙ্গনকে সমৃদ্ধ করবে।
তবে শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাসের সঙ্গে মিশে আছে সংশয়ও। অনেকে আশঙ্কা করছেন, নির্বাচিত হওয়ার পর যদি নেতারা শিক্ষার্থীদের স্বার্থ ভুলে যান, তাহলে এই আনন্দ অর্থহীন হয়ে যাবে। অনেকেই তাই ডাকসুর নেতৃত্বে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সত্যিকারের ছাত্রস্বার্থকে সবার আগে গুরুত্ব দেওয়ার দাবি করছেন।
নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী, প্রার্থীদের বাছাই চলবে ২১ আগস্ট পর্যন্ত। ২৬ আগস্ট প্রকাশ হবে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা। আর ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে ৯ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত। মোট ভোটার সংখ্যা ৩৯ হাজার ৭৭৫ জন। এর মধ্যে ছাত্র ২০ হাজার ৮৭১ এবং ছাত্রী ১৮ হাজার ৯০২ জন।
দীর্ঘ বিরতির পর এই ডাকসু নির্বাচন ঢাবি শিক্ষার্থীদের সামনে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। কারা নির্বাচিত হবেন, তা নির্ধারণ করবে ভোটের মাঠে শিক্ষার্থীদের সিদ্ধান্ত। তবে যাঁরাই আসুন, শিক্ষার্থীদের একটাই প্রত্যাশা—ডাকসু যেন কেবল একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান না থেকে সত্যিকার অর্থে শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে।
এআর/

