শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

কেমন ডাকসু চান শিক্ষার্থীরা?

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮ আগস্ট ২০২৫, ১২:৫১ পিএম

শেয়ার করুন:

কেমন ডাকসু চান শিক্ষার্থীরা?

দেশের ‘দ্বিতীয় সংসদ’ খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই দেশ ও জাতির নানা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ ও ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ডাকসু নেতৃত্ব দিয়েছে সম্মুখ সারিতে। আর তাই ডাকসু নির্বাচন নিয়ে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত এই প্রার্থীরাই হাল ধরবে আগামীর বাংলাদেশের।

শিক্ষার্থীদের নানা দাবি-দাওয়া, আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক এই ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। তপসিল ঘোষণার পরপরই শিক্ষার্থীদের মধ্যে নির্বাচনি আমেজ দেখা যাচ্ছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নিজেদের জায়গা থেকে সবার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। বিভিন্ন দলের প্রার্থীরাও হলে হলে জনমত গড়ার জন্য কাজ করছে। আগামী ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিতব্য এই ছাত্র সংসদ কেমন দেখতে চান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা? নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে কিইবা তাদের চাওয়া-পাওয়া?


বিজ্ঞাপন


এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও হলের দশের অধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় ঢাকা মেইলের। তারা জানান, ডাকসু হতে হবে নিরপেক্ষ একটা বিষয়; যেখানে কোনোভাবেই দলীয় রাজনীতির স্থান হবে না। তাই আমরা একটু ভেবে-চিন্তে যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দেব। যাতে ডাকসু সকল রাজনৈতিক দলের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে আগে থাকা গেস্ট রুম ও গণরুম নামের টর্চার সেল যাতে আর কোনদিন না ফিরতে পারে। শিক্ষার্থীদের জন্য, শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া এবং তাদের সুবিধা-অসুবিধাগুলো নিয়ে সবসময় কাজ করবে ডাকসুর প্রতিনিধিরা, এটাই যেন হয় ডাকসুর একমাত্র লক্ষ্য।

কথা হয় জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সাবেক সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী এবি জুবায়েরের সঙ্গে। কেমন ডাকসু চান?— এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পরে আমাদের মৌলিক চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে অন্যতম একটি বিষয় ছিল ডাকসু নির্বাচন বা ছাত্র সংসদ নির্বাচন। লেজুড়বৃত্তির বাহিরে গিয়ে নিয়মতান্ত্রিক ধারায় সুষ্ঠুপন্থার রাজনীতি চর্চার জন্য এই ডাকসু দরকার। যেখানে ছাত্রদের অধিকার ও তাদের সামগ্রিক কল্যাণের কথা বলা হবে।

জুবায়ের বলেন, ডাকসুটা দেরি হয়ে গেছে আরও আগে করা দরকার ছিল। ডাকসুটা এমন হতে হবে, যেন এটি অন্যান্য রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারে। এটি হবে শিক্ষার্থীদের জন্য, শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়া তাদের সুবিধা-অসুবিধাসহ সব বিষয়ে কাজ করবে ডাকসুর নির্বাচিত প্রতিনিধিরা।

নির্বাচনকালীন ডাকসুর নিরাপত্তার বিষয়ে জুবায়ের বলেন, অনেকেই চায়না ডাকসু বা ছাত্র সংসদ নির্বাচন হোক। নির্বাচনের মধ্যবর্তী সময়ে সিকিউরিটির বিষয়ে কনসার্ন আছে। আমরা আগেও দেখেছি যখনই ডাকসুর আলাপ উঠেছে, তখনই ক্যাম্পাসে ককটেল বিস্ফোরণের মতো ঘটনা ঘটেছে। এরা চায় ডাকসু বানচাল করার জন্য, কারণ তাদের লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতিতে ব্যাঘাত ঘটবে।


বিজ্ঞাপন


বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ ও বিজয় একাত্তর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী মো. আশিক বিল্লাহ বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবি হচ্ছে স্বচ্ছতা। ভোটার তালিকা থেকে শুরু করে ভোট গ্রহণ ও ভোটের ফলাফল প্রকাশ পুরো বিষয়টি যেন কোনো ধরনের কারচুপি ছাড়া হয়। ডাকসুর মাধ্যমে গণরুম-গেস্টরুমের কালচার যেন চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় সেই প্রত্যাশা আমাদের। এই ডাকসু কাজ করবে শিক্ষার্থীদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য। সুতরাং ডাকসু হতে হবে শিক্ষার্থীবান্ধব, যেখানে শিক্ষার্থীরা নির্দ্বিধায় তাদের কথা তুলে ধরবে।

তিনি আরও বলেন, আমরা আশা করছি ২০১৯ সালের বিতর্কিত ডাকসু নির্বাচনের পর শিক্ষার্থীরা এবার সুন্দর একটি নির্বাচনি পরিবেশ পাবে। শিক্ষার্থীরা তাদের বহুদিনের জমানো কথা তুলে ধরতে পারবে এই নির্বাচনের মাধ্যমে। আমরা আশা করবো গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়ন এর জন্য কাজ করবে। শিক্ষার্থীদের তাদের অধিকার আদায়ের জন্য বারবার রাস্তায় নামতে হবে না, তাদের রাজপথে রক্ত দিতে হবে না।

অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শিক্ষার্থী মো. আসিফ খান বলেন, ডাকসুর কাজ হচ্ছে স্টুডেন্টদের সার্ভ করা, স্টুডেন্টদের কণ্ঠস্বর হওয়া। এখানে যারা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হবে তারা ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই দলীয় দাসগিরি করে। কে সভাপতি হচ্ছে, কে সহ-সভাপতি হচ্ছে এসব চলে। অথচ চল্লিশ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র একটা অ্যাম্বুলেন্স, ভালো চিকিৎসার জন্য দূরের একটা প্রাইভেট হসপিটালে শিক্ষার্থীদের ছোটাছুটি করতে হয়, প্রতিটি হলে আবাসনের সংকট, খাবারদাবারে রয়েছে অব্যবস্থাপনা; এই সবকিছুই হচ্ছে ছাত্রদের লেজিটেমিট বডি (গণতান্ত্রিক প্রতিনিধি) না থাকার কারণে।

ম্যাসাচুসেট্‌স ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) এর উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, এমআইটি, হার্ভাড ও অক্সফোর্ডের মতো যদি এখানে প্রতি বছর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়, তবে আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি এখানকার প্রতিটি রিডিংরুম, মসজিদ, হলের রুমে এসি থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি হবে, কারো টাকা মেরে খাওয়ার সুযোগ থাকবে না। কারণ তখন আমাদের ছাত্র প্রতিনিধিরা থাকবে। 

তিনি আরও বলেন, এটা সিআর (শ্রেণি প্রতিনিধি) নির্বাচনের মতো, কিন্তু বাংলাদেশে এটাকে পলিটিক্যাল প্যানেল দিয়ে (ডাকসু) পলিটিসাইজ (রাজনৈতিক) করে ফেলা হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের আবাসিক শিক্ষার্থী হেদায়ত উল্লাহ বলেন, একমাত্র ডাকসুর মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে আসা সম্ভব। ডাকসুতে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ছাত্রছাত্রীদের কথা শুনবে, শিক্ষার্থীরা তাদের অধিকার আদায় করে নিতে পারবে। হলের খাবারদাবার, সিটসহ যাবতীয় সমস্যাগুলো নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জানাবে তখন প্রতিনিধিরা সেই সমস্যাগুলো কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করার চেষ্টা করবে। 

ডাকসু না হলে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পরিবর্তে যেকোনো রাজনৈতিক দল তাদের প্রোপাগান্ডা (মতাদর্শ) বিস্তার করার জন্য উঠেপড়ে লাগবে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কথা না শুনে তারা তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে ব্যস্ত হয়ে পরবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার গণরুম-গেস্টরুমের মতো কালচার চালু হওয়ার আশঙ্কা থাকবে বলে উল্লেখ করেন হেদায়েত উল্লাহ।

ইতোমধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের উমামা ফাতেমা আসন্ন ডাকসু নির্বাচনে নিজেকে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ সংগঠনটিও নিজেদের দলীয় প্যানেল ঘোষণা করেছেন। শিক্ষার্থীদের আশা রাখতে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদসহ অন্যান্য দলগুলো প্যানেল নির্বাচন নিয়ে ভাবছে।

প্রতিনিধি/এফএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর