শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

চা পাতার নির্যাসে তৈরি সিলভার কণায় জারবেরা ফুলের আয়ু বৃদ্ধি পাবে

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক, বাকৃবি
প্রকাশিত: ১৯ জুলাই ২০২৫, ০২:৩০ পিএম

শেয়ার করুন:

Gerbera daisies
জারবেরা ফুল।

‘জারবেরা’ বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় কাটফুল, যা বারবার্টন ডেইজি, আফ্রিকান ডেইজি বা ট্রান্সভাল ডেইজি নামেও পরিচিত। জার্মান উদ্ভিদতত্ত্ববিদ ও চিকিৎসক ট্রগোট জার্বারের নাম অনুসারে এ ফুলের নামকরণ করা হয়েছে। নানা রঙ ও আকৃতির কারণে বহুল জনপ্রিয় এই ফুলটি বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হওয়া শীর্ষ দশটি কাটফুলের মধ্যে অন্যতম। বিশ্বব্যাপী ফুলের বাজারে যুক্তরাষ্ট্রে কাটফুল হিসেবে জারবেরা রয়েছে চতুর্থ অবস্থানে এবং এটি সবচেয়ে বেশি কেনা ফুলের তালিকায় শীর্ষ তিনে অবস্থান করছে।

বাংলাদেশেও জারবেরা ফুলের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। উজ্জ্বল রঙ ও আকর্ষণীয় গঠনবৈচিত্র্যের কারণে এটি সৌন্দর্যবর্ধনের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাসাবাড়ি, হোটেল, অফিস কিংবা অনুষ্ঠানের মঞ্চসজ্জায় জারবেরা একটি জনপ্রিয় শোভাদায়ক ফুল। বিশেষ করে বিয়ে, জন্মদিন, করপোরেট অনুষ্ঠান ও জাতীয় দিবসগুলোতে তোড়া, দেয়াল ও টেবিল সাজানোর ক্ষেত্রে এর চাহিদা উল্লেখযোগ্য। ইউরোপীয় এই ফুল বর্তমানে যশোর, গাজীপুর এবং ঢাকার সাভারের বিভিন্ন অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। তবে একটি বড় সমস্যা হলো—ফুলটি কাটার পর এর স্থায়িত্ব বেশিদিন থাকে না।


বিজ্ঞাপন


এই সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক চা পাতার নির্যাস ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধবভাবে সিলভার ন্যানোকণা তৈরি করেছেন, যা জারবেরা ফুলের স্থায়িত্ব প্রায় দ্বিগুণ বাড়াতে সক্ষম। গবেষণায় দেখা গেছে, এই সিলভার ন্যানোকণা ফুলে জীবাণুর বিস্তার রোধ করে, পানির শোষণ বাড়িয়ে ফুলকে দীর্ঘ সময় সতেজ রাখতে সহায়তা করে।

গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন বাকৃবির ফসল উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর হোসেন। গবেষক দলে ছিলেন একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাদিয়া আরেফিন যুথি (যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বপ্রথম ফাইটো ন্যানোকণা নিয়ে কাজ করেছেন) সহ আরও কয়েকজন গবেষক।

‘চা পাতার নির্যাস ব্যবহার করে রূপার অণুকণার পরিবেশবান্ধব সংশ্লেষণ, বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ ও জারবেরা ফুলের স্থায়িত্বে এর প্রয়োগ’ শীর্ষক এই গবেষণা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক জার্নাল ‘পোস্টহারভেস্ট বায়োলজি অ্যান্ড টেকনোলজি’-তে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষণাটির অর্থায়ন করেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সিস্টেম (বাউরেস)।


বিজ্ঞাপন


most
গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন বাকৃবির ফসল উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর হোসেন। এই দলে ছিলেন একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাদিয়া আরেফিন যুথি। 

গবেষণার উদ্দেশ্য সম্পর্কে অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ‘জারবেরা ফুল কাটার পর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শুকিয়ে যায়। কাটার ফলে ইথিলিন নামক উদ্ভিদ হরমোনের উৎপাদন বেড়ে যায়, যা ফুলের কোষে ক্ষত সৃষ্টি করে এবং ধীরে ধীরে পাপড়ি মেলানোর ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, ফলে ফুল দ্রুত ম্লান হয়ে পড়ে। এর পাশাপাশি পুষ্পদণ্ডে ও পানিতে থাকা জীবাণুরাও জল শোষণে বাধা সৃষ্টি করে, যা ফুলের আয়ু কমিয়ে দেয়। সিলভার ন্যানোকণা এই ইথিলিন উৎপাদন কমিয়ে দেয় এবং ফুলকে দীর্ঘসময় সতেজ রাখতে সাহায্য করে।’

গবেষণার পদ্ধতি নিয়ে সহকারী অধ্যাপক সাদিয়া আরেফিন যুথি বলেন, ‘চা পাতার নির্যাস দিয়ে তৈরি রূপার অণুকণাকে পাঁচটি মাত্রায় প্রয়োগ করা হয়েছে—০, ৫, ১০, ২০ পিপিএম এবং তুলনামূলকভাবে ১০ পিপিএম সিলভার নাইট্রেট। এর মধ্যে ১০ পিপিএম রূপার অণুকণা সবচেয়ে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এতে জারবেরা ফুলের স্থায়িত্ব ৬২.২২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া ফুলের সতেজ ওজন ৮৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ পর্যন্ত বজায় থাকে, পানির শোষণ বাড়ে ৪০ শতাংশ, কাণ্ডে সবুজ রঞ্জক ৪৩ শতাংশ এবং পাপড়িতে রঙিন রঞ্জক ১৪৭ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—উক্ত মাত্রার রূপার অণুকণার প্রয়োগে ফুলদানির পানিতে কোনো জীবাণু জন্মায়নি এবং গাছের কাণ্ডে পানি চলাচলের পথও বন্ধ হয়নি।’

গবেষণায় অণুকণার গঠন ও কার্যকারিতা বিশ্লেষণে ব্যবহার করা হয়েছে—অতিবেগুনি-দৃশ্যমান রশ্মি বিশ্লেষণ, ফুরিয়ের ট্রান্সফর্ম ইনফ্রারেড (এফটিআইআর) রশ্মি বিশ্লেষণ, শক্তি বিচ্ছুরণ বিশ্লেষণ (ইডিএস), এক্স-রে গাঠনিক বিশ্লেষণ (এক্সআরডি) এবং চা পাতায় থাকা উপকারী উদ্ভিজ্জ রাসায়নিক উপাদানগুলোর বিশ্লেষণ। অধ্যাপক ড. আলমগীর বলেন, “চা পাতার নির্যাস দিয়ে আমরা একইসঙ্গে ন্যানোকণা ও স্ট্যাবিলাইজার তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি।

সিলভার ন্যানোকণার ব্যবহারবিধি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ফুল কাটার পর কাটাস্থানে ন্যানোকণা মিশ্রিত পানি স্প্রে করতে হবে অথবা সেই অংশটিকে ন্যানোকণা মিশ্রিত পানিতে ডুবিয়ে তারপর ফুলদানিতে রাখতে হবে। একইভাবে ফুলের তোড়া তৈরির সময়ও কাটা অংশ ন্যানোকণা মিশ্রিত পানিতে চুবিয়ে নেওয়া যেতে পারে। ভোক্তাদের জন্য একটি ছোট শিশিতে ন্যানোকণা সরবরাহ করা হলে তারা তা সহজেই ফুলের আয়ু বৃদ্ধিতে ব্যবহার করতে পারবেন।’

খরচ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাণিজ্যিকভাবে এ প্রযুক্তি চালু হলে এর খরচ অনেক কম হবে, কারণ এটি খুবই অল্প পরিমাণে প্রয়োগ করলেই কার্যকর হয়।’

sss

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও সম্ভাবনা নিয়ে অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ‘পরিবেশবান্ধব এই রূপার অণুকণার প্রয়োগ শুধু জারবেরা নয়, অন্যান্য ফুলের ক্ষেত্রেও কার্যকর হতে পারে। এটি দেশের ফুল শিল্পে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। প্রযুক্তিটি ব্যবহার করলে ফুলের অপচয় কমবে, কৃষকের লাভ বাড়বে এবং ফুল রপ্তানিতেও নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আমরা এটি বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করতে পারব।’

প্রতিনিধি/একেবি

 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর