জুলাই বিপ্লবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। তাদের দমন করার দায়িত্ব নিত তৎকালীন সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন (জুলাই পরবর্তী সময়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত) ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। বিভিন্ন হুমকিধামকি দিয়ে তারা আন্দোলনের কর্মসূচিতে অংশ নিতে বাধা দিত। বিভিন্ন ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালাত তারা। শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারে, ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত না করতে পারলে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া কঠিন হবে। এই উপলব্ধি থেকে প্রথমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করে।
গত বছরের ১৬ জুলাই বিকাল তিনটার দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ সকল নেতাকর্মীকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়। রাবি হয়ে ওঠে ছাত্রলীগমুক্ত প্রথম ক্যাম্পাস।
বিজ্ঞাপন
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও সাবেক সমন্বয়কদের সাথে কথা বলে সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে অনেক কিছু জানা গেছে। তাদের বরাতে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মোড় ঘুরে যায় ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করার মাধ্যমে। দিনটি ছিল ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই। সেদিন শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি ছিল বেলা আড়াইটায়। তবে ছাত্রলীগ পূর্বঘোষিত কর্মসূচি নস্যাৎ করতে একই স্থানে এক ঘণ্টার ব্যবধানে জমায়েতের ডাক দেয়। কিন্তু সব কিছু গোপন রেখে দু-তিন ঘণ্টা আগে থেকে শিক্ষার্থীদের বের হয়ে আসতে বলা হয়।
মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) দুপুর আড়াইটায় বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুরের মন্ডলের মোড় থেকে দুশো-আড়াইশোর মতো শিবিরকর্মী নিয়ে তৎকালীন রাবি শিবির অফিস সম্পাদক ইমরান নাজিরের নেতৃত্বে একটি দল বের হয়। সেসময় চারিদিক থেকে শত শত শিক্ষার্থী তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেট ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করে। সেখানে প্রায় ১০০ জন পুলিশ থাকলেও তারা বাধা দেয়নি। তখন ছাত্রলীগের হাত থেকে প্রতিরোধ করার জন্য শিক্ষার্থীদের হাতে ছিল রড, পাইপ ও লাঠিসোঁটা।
শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে প্রবেশের ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে মুহূর্তের মধ্যে সব হলের শিক্ষার্থীরা হল থেকে বের হতে থাকে। বিক্ষোভ মিছিলটি জোহা চত্বরের পশ্চিম পাশ দিয়ে প্যারিস রোডে এলে বিপরীত দিক থেকে আরও কয়েকশ শিক্ষার্থী এসে মিলিত হয়। মিছিলটি মেয়েদের হলের সামনে এলে হাজার দেড়েকের মতো মেয়ে শিক্ষার্থীর দল যোগ দেয়।
বিজ্ঞাপন
মিছিলটি বিজ্ঞান ভবনের পাশ দিয়ে হবিবুর রহমান হলের মাঠ হয়ে শহীদ জিয়াউর রহমান হলের সামনে পৌঁছায়। তখন শিক্ষার্থীরা হলের সামনে অবস্থান নেয়া ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের হলের ভেতর থেকে প্রতিহত করতে শুরু করে। সেখানে ইটপাটকেল খেয়ে মাদার বখ্শ হলের সামনে যায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ততক্ষণে সোহারাওয়ার্দী ও জোহা হলের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শাহ মখদুম, লতিফ ও আমীর আলী হলের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ-হিল গালিবকে তাড়া করে। ফলে সাড়ে ১৫ বছরের রাজত্ব ফেলে মোটরসাইকেলে চড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সাধারণ সম্পাদক গালিবের পালানোর ১০ সেকেন্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ভাইরাল হয়। তার হলের কক্ষটি ভাঙচুর করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
এরপর বিক্ষোভ মিছিল বিজয় ২৪ হলের (তৎকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল) সামনে এসে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের রুম ভাঙচুর করে। শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবুকে পুলিশ উদ্ধার করে অন্যত্র নিয়ে যায়। ছাত্রলীগের সভাপতি ও সেক্রেটারির কক্ষ এবং দপ্তর সেল থেকে তিনটি পিস্তল, ছয়টি রামদা, ১০-১৫টি মদের বোতল, কয়েকটি ছুরি সহ রড উদ্ধার করে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা। পরে এসব অস্ত্র রাবি প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
সেদিন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পালিয়ে যাওয়া প্রত্যক্ষ করেন সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক মেশকাত চৌধুরী মিশু। তিনি বলেন, ১৬ জুলাই শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি ছিল বেলা আড়াইটায়। এ কর্মসূচি নস্যাৎ করতে একই স্থানে জমায়েতের ডাক দেয় সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগ। এছাড়া প্রতিটি হলের সামনে চেয়ার পেতে পর্যবেক্ষণ করত তারা। কয়েকটি হলের গেট তারা তালা মেরে দেয় যাতে হলে থাকা শিক্ষার্থীরা কর্মসূচিতে যেতে না পারে। তাদের সকল ষড়যন্ত্রকে উপেক্ষা করে সেদিন সবচেয়ে বড় আন্দোলন সংগঠিত হয়।
তিনি আরো বলেন, ওইদিন আমি ছাত্রলীগের গতিবিধি লক্ষ্য করতে মাদার বখ্শ হলের সামনে আসি। দেখি ছাত্রলীগের সেক্রেটারি গালিব তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে বেঞ্চে বসে আছে। কিছুক্ষণ পরেই কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর একটি বিক্ষোভ মিছিল আসাদুল্লাহ-হিল গালিব ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের তাড়া করে। এতে তারা আতঙ্কিত হয়ে মোটরসাইকেলে চড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। নিমেষেই তাদের দীর্ঘদিনের মসনদ ভেঙে খান খান হয়ে যায়। বিরল সে মাহেন্দ্রক্ষণ স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য আমার হলো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে ছাত্রলীগমুক্ত প্রথম ক্যাম্পাস।
আন্দোলনে শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী সানজিদা ঢালি। তিনি বলেন, ১৬ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ছিল। এই ঘটনার জন্য আমাদের প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল ১৫ তারিখ থেকেই। যদিও আন্দোলনের সময় নির্ধারণ ছিল ১৬ জুলাই বিকাল ৩টা। তবে ছাত্রলীগের সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কায় আমরা গোপনে সময় এগিয়ে এনে দুপুর আড়াইটায় আন্দোলন শুরুর সিদ্ধান্ত নিই। মেয়েদের হলগুলোর সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে। সেই অনুযায়ী আমি ১৬ তারিখ দুপুর ১টা থেকেই মন্নুজান হলে ঘণ্টা বাজিয়ে ডাকাডাকি শুরু করি এবং আন্দোলনের জন্য মেয়েদের জড়ো করতে থাকি। পরে একত্রিত হয়ে আমরা অন্যান্য হলগুলোতেও যাই এবং স্লোগানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে আহ্বান জানাতে থাকি।

তিনি আরও বলেন, সব হলের শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়ে যখন মন্নুজান হলের সামনে অবস্থান নেয়, তখন দেখি ছেলেরা প্যারিস রোড হয়ে মিছিল নিয়ে এগিয়ে আসছে। আমরা মেয়েরা সেই মিছিলে যুক্ত হই এবং একসঙ্গে পুরো ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করি। আমাদের মিছিলের সংখ্যা এতটাই বড় ও শক্তিশালী ছিল যে, ছাত্রলীগ তখন ভয়ে পালিয়ে যেতে শুরু করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সমন্বয়ক মেহেদী সজীব বলেন, ১৬ জুলাই আমরা সর্বপ্রথম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করি। এরপর ওইদিন রাতে ও পরদিন সকাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করা হয়। মূলত ছাত্রলীগকে বের করার মাধ্যমেই ৫ আগস্টের অভ্যুত্থান রচিত হয়। ইতিপূর্বে ফ্যাসিস্ট রেজিমের পেটোয়া বাহিনীকে আমরা ক্যাম্পাস থেকে বের করতে পারিনি এবং ছাত্রলীগই বারবার আমাদের আন্দোলনে মারপিট করে দমন করেছে, যা আমরা ২০১৮ সালেও দেখেছি। তাই আমি মনে করি, এই ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করার মাধ্যমেই নতুন বাংলাদেশের শুভ সূচনা হয়েছে।
প্রতিনিধি/ একেবি

