সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত ৫৫টি মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস ফাইনাল প্রফেশনাল পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ডিএমসি) কে-৭৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ডা. ইশমাম সাকিব অর্ণব। এর আগে ২০১৮-১৯ সেশনে এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় জাতীয় মেধায় প্রথম হয়েছিলেন খুলনার এ কৃতি সন্তান। এবার তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিবিএস ফাইনাল প্রফেশনাল পরীক্ষায় সেরা ফলাফল করে নামের আগে ডাক্তার লেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। ফাইনাল প্রফেশনাল পরীক্ষার তিন বিষয়েই মেডিকেলের সর্বোচ্চ নম্বর অনার্স মার্ক পেয়েছেন ডা. ইশমাম সাকিব অর্ণব। ৫৫টি মেডিকেলের প্রায় ছয় হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে এ অর্জন করেছেন তিনি। শুক্রবার (১৪ মার্চ) ঢাকা মেইলের সঙ্গে কথা হয় তরুণ উদীয়মান এ চিকিৎসকের। গল্প শুনেছেন সাখাওয়াত হোসাইন।
অনুভূতি
বিজ্ঞাপন
ডা. ইশমাম সাকিব অর্ণব বলেন, আলহামদুলিল্লাহ, এতো ভালো ফলাফল করবো এটা অপ্রত্যাশিত ছিল। আমি খুবই খুশি, আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো আমার মা-বাবা, কাছের মানুষ, বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজন, শিক্ষক; সবাই অনেক খুশি। তাদের আনন্দ দেখে আমিও অনেক খুশি।
অনুপ্রেরণা
ফাইনাল প্রফেশনাল পরীক্ষায় পাস করাটাই অনেক বড় ব্যাপার বলে মনে হতো। আমি চেষ্টা করেছি, যতটুকু সম্ভব নিজের সর্বোচ্চটা দেওয়ার। এরপর তো আমরা প্রফেশনাল জীবনে প্রবেশ করি। যতটুকু সম্ভব, শেখার চেষ্টা করেছি। আর যাই করি না কেন, ভালোভাবেই করতে চেয়েছি; অনুপ্রেরণা বলতে মনে হয়, এটাই। আর বাকিটুকু আল্লাহর হাতে।
পড়াশোনার কৌশল
বিজ্ঞাপন
পরীক্ষা সম্পর্কিত পড়াশোনা করা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এমবিবিএসের সিলেবাস অনেক বড়। পরীক্ষায় কীভাবে প্রশ্ন আসে বা কীভাবে পরীক্ষা দেই, এগুলো চিন্তা করা। আর আমি যাই পড়েছি, নোট রাখার চেষ্টা করেছি। বিগত বছরের প্রশ্নগুলো সমাধান করেছি। আর যতটুকুই পড়েছি, তা সুন্দরভাবে পড়েছি এবং যাতে তা আমি ভালোভাবে ডেলিভারি দিতে পারি।
এমবিবিএসের পথ-পরিক্রমা
এমবিবিএসের সময়টা অনেক কঠিন ছিল, আমি যেমন ভেবেছি, তার থেকেও অনেক বেশি কঠিন ছিল। ফার্স্ট ইয়ারে মজার সময় কেটেছে, তখন নতুন ছিলাম। ব্যাচমেটদের সাথে পরিচয় হওয়া, ভালোই সময় কেটেছে। যখন তৃতীয় বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষে উঠেছি, তখন মনে হয়েছে মেডিকেল আসলেই অনেক কঠিন। আর নিজের ভালো লাগার জন্য যা করা দরকার, তা করার চেষ্টা করেছি। আমি পড়াশোনার দিকে বেশি ফোকাস দিয়েছি। সেইসঙ্গে জুনিয়রদেরকেও পড়াশোনার প্রতি উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করেছি, যাতে নিজের পড়াশোনাটা ভালো হয়। দেখতে দেখতে কিভাবে এমবিবিএসের সময়টা পার হয়ে গেছে বুঝতে পারিনি।
ক্যারিয়ার
ব্যক্তিগতভাবে মেডিসিন বিষয়টা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি। এখনও মেডিসিন নিয়েই চিন্তা করছি। তবে এখনও সাব-স্পেশালিটি পছন্দ করিনি। ইন্টার্নশিপ করার পর কোনো সাবজেক্ট পছন্দ হলে সেদিকে যাবো; না হয় মেডিসিনেই থাকবো। আর মেডিসিনে ফ্যাক্টগুলো বিশ্লেষণ করা আর মনে রাখা; এ দু’টি বিষয় আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। এছাড়া মেডিসিন পড়লে পরবর্তীতে সবাইকে কোনো না কোনোভাবে সংযুক্ত করা যায়।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বলতে সেভাবে এখনও তেমন কিছু ঠিক করিনি। আপাতত সামনের পরীক্ষা যা আছে, তা দিতে চাই। আর খুব বড় কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আমার কাছে নেই। আর যেদিকেই যাই, সেখানে নিজেকে একেবারে সেরা না; নিজেকে প্রথম সারিতে দেখতে চাই। আমার কাজের মাধ্যমে মানুষ যেন উপকৃত হয় এবং কাজের মধ্যে কোনো ভুল না থাকে, আমার নিজের মধ্যেও যেন কোনো সংশয় না থাকে, সে জায়গায় নিজেকে দেখতে চাই।
জুনিয়রদের জন্য পরামর্শ
এমবিবিএসে যারা ভালো করতে চায়, তাদেরকে তিনটা জিনিস করতে হবে। এক. যতটুকু পড়ছি, তা সংক্ষিপ্ত করে পড়া; নোট করে রাখা এবং তা যেন মনে থাকে। দুই. ডেলিভারি যেন ভালো হয়; এমবিবিএসের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে ভাইবার গুরুত্ব অনেক বেশি। পড়া শুধু পড়লেই হবে না, তা বলতে পারি এবং লিখতে পারি। তিন. মেডিকেল প্রফেশন এবং এমবিবিএস অনেক কঠিন। আমরা অনেক ভেঙে পড়ি, আমার নিজেরও মনে হয়েছে আর পারছি না। যত কঠিন পরিস্থিতি নিজের সামনে আসুক, ধৈর্য ধারণ করে লেগে থাকতে হবে এবং নিজেকে মোটিভেট করতে হবে। সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে, পেছনে ফিরে তাকানোর সময় নেই।
চ্যালেঞ্জ
এমবিবিএসের সময়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এত পড়াশোনা আর নিয়মিত পড়াশোনার মধ্যে থাকা। এমবিবিএসে অনেক বেশি পড়তে হয়। নিয়মিতভাবে পড়তে হয়, কোনো না কোনো পরীক্ষা থাকে; এটা মোকাবিলা করা কষ্ট হয়। আর এমবিবিএসের শিক্ষার্থীদের বাহিরের জগতের সঙ্গে যুক্ত থাকাও কঠিন এবং সুযোগ কমে আসে, এটা অনেক চাপ মনে হয়। বন্ধুকে সময় দেওয়ার মতো সময় পাওয়া যায় না এবং নিজেকে সময় দেওয়ার মতো সময় পাওয়া যায় না; এটা কঠিন। শুধুমাত্র একদিকে নিজেকে ফোকাস না রেখে সবদিকে খেয়াল রাখার চেষ্টা করেছি।
পরিবার ও মেডিকেলের সহযোগিতা
আমার বাবা-মা কাছে থাকেন না, তারা ঢাকার বাহিরে থাকেন। পরিবারের কাছ থেকে অনেক সহযোগিতা পেয়েছি, যেকোনো সমস্যায় পরিবার এগিয়ে এসেছে। আমি যখন বলতাম, আমাকে দিয়ে এই পড়াশোনা হচ্ছে না, এখানে এসে ভুল করেছি। এই সময়টাতে বাবা-মা অনেক উৎসাহ দিয়েছেন। আর বন্ধুরাও অনেক সহযোগিতা করেছে, তারা (বন্ধুরা) সবসময় আপডেট থাকতে সহযোগিতা করতো। আর শিক্ষকদের অনেক ভূমিকা রয়েছে, কীভাবে পড়তে হবে বা কী করতে হবে; সবসময় পরামর্শ দিতেন। শিক্ষকদের আন্তরিকতারও কোনো কমতি ছিল না, অনেক বেশি সহযোগিতা করতেন।

ছোট ভাইয়ের জন্য মেডিকেলে
আমার ছোট ভাই স্পেশাল চাইল্ড। তার নাম অর্পণ, সে অটিজমে আক্রান্ত। এই বিষয়টা মেডিকেলে পড়তে আসার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা দিয়েছে; আর আমার কখনও এমবিবিএসে পড়তে আসার ইচ্ছা ছিল না। বাবা-মায়ের ইচ্ছা ছিল, আর আমার ইচ্ছা ছিল যেকোনো একটা বেসিক (রসায়ন বা পদার্থ) সাবজেক্টে পড়াশোনা করে পিএইচডি করতে বিদেশ চলে যাওয়া। আর আমি অর্পণকে দেখে বড় হয়েছি, আমার ইচ্ছা ছিল তার জন্য কিছু একটা করা, আর আমার বেড়ে উঠা অর্পণ কেন্দ্রিক। বাংলাদেশে সুস্থ মানুষদেরই চিকিৎসা পেতে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়; আর অসুস্থ মানুষের কী অবস্থা হয়? আমি যদি কখনও ভালো ডাক্তার হই, ছোট ভাইয়ের মতো যারা আছে, তাদেরকে নিয়ে কাজ করতে চাই।
বেড়ে ওঠা
১৯৯৯ সালে খুলনা শহরে জন্মগ্রহণ ইশমাম সাকিব অর্ণব। দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় তিনি। তার বাবা একজন বেসরকারি চাকরিজীবী, মা গৃহিণী। ২০১৬ সালে খুলনার সেন্ট জোসেফ স্কুল থেকে এসএসসি আর খুলনা সরকারি এমএম সিটি কলেজ থেকে ২০১৮ সালে এইচএসসি পাস করেন। ২০১৮-১৯ সেশনে এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় জাতীয় মেধায় সারাদেশে প্রথম স্থান অর্জন করেন ইশমাম সাকীব অর্ণব। পরে এমবিবিএসের ফার্স্ট প্রফেশনাল পরীক্ষায় তিন বিষয়ে অনার্স মার্ক পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অষ্টম স্থান অধিকার করেন এবং তৃতীয় প্রফেশনাল পরীক্ষায় দুই বিষয়ে অনার্স মার্ক পেয়েছিলেন খুলনার এ কৃতি সন্তান।
এসএইচ/এফএ