• ১৪ শিক্ষক বেতন নেন দুই পদের, বছরে বাড়তি নিচ্ছেন প্রায় ৩০ লাখ
• ভুয়া সনদে চাকরি নেওয়ার অভিযোগ, নন এমপিও শিক্ষক থেকে অধ্যক্ষের চেয়ারে হারুন
• এনটিআরসিএর জাল সনদে চাকরি, হয়েছেন এমপিওভুক্তও
• ছয় শিক্ষকের নিয়োগে ডিজির প্রতিনিধি নিয়েও জালিয়াতির অভিযোগ
• নিয়ম না মেনে গণহারে প্রভাষকদের সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি
• তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে: গভর্নিং বডির সভাপতি
অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ যেন পিছু ছাড়ছে না রাজধানীর উত্তরার নওয়াব হাবিবুল্লাহ মডেল স্কুল এন্ড কলেজ। কখনো গভর্নিং বডির সভাপতি, কখনো প্রতিষ্ঠান প্রধান, আবার রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করছেন। অর্থের বিনিময়ে ত্রুটিপূর্ণ নিয়োগ নিয়েও একাধিক শিক্ষককে এমপিওভুক্ত করা, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে এমপিওভুক্ত করা, একই শিক্ষক সরকার থেকে প্রভাষক পদে বেতন নিলেও প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মের স্পষ্ট লঙ্ঘন করে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে বেতন নিচ্ছেন বছরের পর বছর। এতে একদিকে আইনের লঙ্ঘন হচ্ছে, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে বছরে কোটি কোটি টাকা তছরুপ হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি একাধিক শিক্ষকের বেতন বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে বলে জানা গেছে।
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি একাধিক শিক্ষক ও প্রভাষক নিয়োগে অনিয়ম, নিয়োগে ডিজির প্রতিনিধি না থাকা, আর্থিক লুটপাটের ফিরিস্তি তুলে ধরে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ জমা পড়েছে। এরআগে আর্থিক কেলেঙ্কারি, নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগে এখানকার সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. শাহিনুর মিয়া বরখাস্ত হয়েছেন।
প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ আমলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা প্রয়াত সাহারা খাতুন, সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ হাবিব হাসান ও খসরু চৌধুরীর ছত্রছায়ায় প্রতিষ্ঠান প্রধান, গভর্নিং বডির সদস্যরা মিলে এসব অনিয়ম, দুর্নীতি করেছেন। অনিয়মের প্রতিবাদ করে নাজেহালও হয়েছেন একাধিক শিক্ষক। তবে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ শিক্ষকরা সুর পাল্টে ফেলতে শুরু করেছেন বলে জানা গেছে।
প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামীপন্থী শিক্ষকরা এখন স্থানীয় বিএনপি নেতা সালাম সরকারের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে বহাল তবিয়তে আছেন। তিনি প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের হিসেবও নিচ্ছেন। সালাম সরকার ভবিষ্যতে এখানকার সভাপতি হতে চান।
বিজ্ঞাপন
ইতোমধ্যে এসব অভিযোগ গভর্নিং বডির সভাপতির দায়িত্বে থাকা সরকারের উপসচিব মো. ছাদেকুর রহমানের কাছেও এসেছে। অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণেরও কথা বলছেন উত্তর সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কর্মকর্তা ছাদেকুর।
আওয়ামী লীগ আমলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা প্রয়াত সাহারা খাতুন, সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ হাবিব হাসান ও খসরু চৌধুরীর ছত্রছায়ায় প্রতিষ্ঠান প্রধান, গভর্নিং বডির সদস্যরা মিলে এসব অনিয়ম, দুর্নীতি করেছেন। অনিয়মের প্রতিবাদ করে নাজেহালও হয়েছেন একাধিক শিক্ষক। তবে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ শিক্ষকরা সুর পাল্টে ফেলতে শুরু করেছেন।
ঢাকা মেইলকে মো. ছাদেকুর রহমান বলেন, ‘শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মসহ প্রতিষ্ঠানটির বেশ কিছু অভিযোগের কথা জেনেছি। ১৫টির মতো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে এসব বিষয় খতিয়ে দেখতে একটু সময় লাগবে। তবে কোথাও কোনো অনিয়ম পেলে অবশ্যই জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মাউশি-দুদকে কলেজ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ
২০০৯ সালের জুলাই মাসে ছয়জন প্রভাষক নিয়োগ দেওয়া হয় কলেজটি। তবে নিয়োগ পরীক্ষায় ডিজির প্রতিনিধি ছিলেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। অবশ্য নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকরা বলছেন, ডিজির প্রতিনিধিসহ নিয়োগ পরীক্ষায় সব ধরনের নিয়ম মানা হয়েছে।
এদিকে ওই নিয়োগ পরীক্ষায় ডিজির প্রতিনিধি ও বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে নয়জন শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন এমনটা দাবি করা হলেও চলতি বছরের ২৮ মার্চ ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ প্রতিনিধি পাঠানোর চিঠির কোনো সত্যতা যাচাই সম্ভব হয়নি বলে লিখিতভাবে জানিয়েছেন। যদিও সেই সময়ে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকরা ২০১৯ সালে এমপিওভুক্তও হয়েছেন।
এমপিও হওয়ার সময় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছিলেন হারুন অর রশিদ। অভিযোগ আছে, নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হন তিনি। কারণ এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাদ দিয়ে নন এমপিও শিক্ষক হওয়ার পরও তিনি প্রতিষ্ঠান প্রধান হন। বাকি শিক্ষকদের এমপিও করাতে আর্থিক লেনদেনেরও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।
শুধু তাই নয়, হারুন অর রশিদ উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের সনদ জমা দিয়েছেন। সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ করা হয়েছে, তার এই সনদটি সঠিক নয়। একই সময়ে অন্য সনদের সঙ্গে তার দেওয়া সনদের পার্থক্য পাওয়া গেছে।
এমপিও হওয়ার সময় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছিলেন হারুন অর রশিদ। অভিযোগ আছে, নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হন তিনি। কারণ এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাদ দিয়ে নন এমপিও শিক্ষক হওয়ার পরও তিনি প্রতিষ্ঠান প্রধান হন। বাকি শিক্ষকদের এমপিও করাতে আর্থিক লেনদেনেরও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।
অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করে হারুন অর রশিদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘শতভাগ শুদ্ধভাবে নিয়োগ পেয়েছি। যারা অন্যের ভালো দেখতে পারে না তারা এসব অভিযোগ করছে।’
নন এমপিও শিক্ষক হয়েও কিভাবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হলেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘তখন কোনো সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন না। পরে আমাকে কমিটি মনে করেছে তাই এই পদে বসেছি। আমি তো জোর করে বসতে পারি নাই।’
তথ্যমতে, ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন হারুন অর রশিদ। ওইসময় তিনি ননএমপিও প্রভাষক হিসেবে কলেজ থেকে ২২ হাজার টাকা স্কেলে বেতন পেতেন। কিন্তু অধ্যক্ষের চেয়ারে বসে বেতন নিয়েছেন লাখ টাকার উপরে। সবমিলিয়ে এই সময় তিনি বেতন হিসেবে নিয়েছেন ৫০ লাখ টাকার বেশি। এছাড়াও নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা খাত থেকে কোটি টাকার বেশি তছরুপ করেছেন বলেও অভিযোগ আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার বেতন ২২ হাজার। কিন্তু কমিটি যদি লাখ টাকা দেয় আমার কি করার আছে? কেন এত টাকা দিয়েছে সেই প্রশ্ন কমিটিকে করতে পারেন।’
ভুয়া সনদের বিষয়ে এই শিক্ষক বলেন, ‘আল্লাহর কসম আমি পড়ালেখা করে সনদ নিয়েছি। কলেজ থেকে যাচাইও করেছে। আপনারাও চাইলে যাচাই করতে পারেন। আমার সনদে ভুল নেই।’
২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন হারুন অর রশিদ। ওইসময় তিনি ননএমপিও প্রভাষক হিসেবে কলেজ থেকে ২২ হাজার টাকা স্কেলে বেতন পেতেন। কিন্তু অধ্যক্ষের চেয়ারে বসে বেতন নিয়েছেন লাখ টাকার উপরে। সবমিলিয়ে এই সময় তিনি বেতন হিসেবে নিয়েছেন ৫০ লাখ টাকার বেশি। এছাড়াও নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা খাত থেকে কোটি টাকার বেশি তছরুপ করেছেন বলেও অভিযোগ আছে।
শুধু তাই নয়, বর্তমান অধ্যক্ষ, হারুন অর রশীদসহ ২০১৯ সালে এমপিওভুক্ত হওয়া প্রভাষকরা সরকারি নীতিমালা না মেনে ৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই জ্যেষ্ঠ প্রভাষকের স্কেল ৩৫,৫০০-৬৭০১০/- বেতন নিচ্ছেন প্রতিষ্ঠান থেকে। অথচ সরকারি খাত থেকে বেতন নিচ্ছেন প্রভাষক পদের।
তথ্য বলছে, অতিরিক্ত বেতন নেওয়া এমন শিক্ষকের সংখ্যা ১৪ জন। যাদের চাকরির বয়স অনুযায়ী সরকারি বেতনের পরিমাণ মাসে ২৮ হাজার টাকার মতো। কিন্তু তারা প্রতিষ্ঠান থেকে ‘সহকারী অধ্যাপক’ হিসেবে মাসে ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন নিচ্ছেন। প্রতিমাসে একেকজন বেশি নিচ্ছেন ১৭ হাজার টাকারও বেশি। বছরে যার পরিমাণ প্রায় ২৩ লাখ টাকা।
একজন মানুষ দুই পদের বেতন নিতে পারেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মির্জা মাহমুদা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আপনাকে কিছু বলতে চাই না।’
আর প্রতিষ্ঠানের প্রভাবশালী শিক্ষক হারুনুর রশিদ বলেন, ‘এখানে নিয়মের কোনো ব্যত্যয় হয়নি। আমরা যে এমপিও ছাড়া ২০০৯ সাল থেকে কলেজে কাজ করেছি সেই সার্ভিস কি বাদ যাবে? আর প্রতিষ্ঠানের টাকা আছে সেখানে এমপিও স্কেলের চেয়ে বেশি বেতন নিতে সমস্যা কোথায়?’
যদিও নীতিমালা অনুযায়ী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত প্রভাষক ৫ দশমিক ২ এর ভিত্তিতে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক পদে পদোন্নতি পাওয়ার কথা। কিন্তু এখানে এমপিও ও নন এমপিও প্রভাষকরা গণহারে সহকারী অধ্যপক পদে পদোন্নতি নিয়ে নিয়েছেন।
এদিকে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে মির্জা মাহমুদা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হয়েছেন এমন অভিযোগও করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি জ্যেষ্ঠ শিক্ষক। তাই নিয়ম মেনে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এরবাইরে কিছু জানতে হলে কমিটির সঙ্গে কথা বলতে পারেন।’
এছাড়াও ইংরেজি প্রভাষক মো. বাহাদুর হোসেন ও গণিতের মো. ওসমান গনি সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ পেলেও পরবর্তীতে অসাধু উপায়ে তারা প্রভাষক পদে নিয়োগ নেন। অভিযোগ আছে, কমিটিতে শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে থাকার সুযোগে বাহাদুর হোসেন পরবর্তীতে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ নেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসাধারণের জন্য তাকে একবার বরখাস্ত করা হলেও পরে আওয়ামী লীগের স্থানীয় এমপির নির্দেশে আবার ফিরে আসেন।
অন্যদিকে এনটিআরসিএ’র ভুয়া সনদ নিয়ে চাকরি নেওয়ার অভিযোগ আছে শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক মো. আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে। মাউশির পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর থেকে তার নিয়োগ বিধিসম্মত হয়নি বলে প্রতিবেদন দেয়া হলেও জালিয়াতি করে তিনি এমপিওভুক্ত হয়েছেন।
এনটিআরসিএর সনদ জালিয়াতির অভিযোগ আছে জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মো. সিরাজুল ইসলামের বিরুদ্ধেও। এছাড়াও কারিগরি শাখায় শরিফা আক্তার ও জবা রানী রায় কাম্য যোগ্যতা ও এনটিআরসিএর সনদ ছাড়াই নিয়োগ নিয়েছেন এমন অভিযোগও উঠেছে।
এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মির্জা মাহমুদা বলেন, ‘টেলিফোনে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে রাজি না। বেশি কিছু জানতে চাইলে আপনাকে কলেজে আসতে হবে।’
বিইউ/এএস