রোববার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

‘অযৌক্তিক’ কোটা বাতিল চান শিক্ষার্থীরা

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ১০ জুলাই ২০২৪, ০৮:৫৯ এএম

শেয়ার করুন:

‘অযৌক্তিক’ কোটা বাতিল চান শিক্ষার্থীরা
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত

কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনে উত্তপ্ত দেশের রাজপথ। বিক্ষোভসহ নানা কর্মসূচি পালনের পর দুই দিন ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। এতে বেশ সাড়া পাওয়ায় এক দিন বিরতি দিয়ে আজ বুধবার (১০ জুন) সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা ‘ব্লকেড’ কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামছেন তারা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে ক্রমেই এই আন্দোলন আরও শক্তিশালী ও বেগবান হচ্ছে।

এবারের কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে শুরু থেকেই একটা বিভ্রান্তি রয়েছে- এটা কোটা সম্পূর্ণ বাতিলের আন্দোলন নাকি সংস্কারের। আন্দোলন নিয়ে দেশের মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর সংবাদেও এ বিভ্রান্তির চিত্র দেখা যাচ্ছে। প্রকাশিত সংবাদগুলোতে এ আন্দোলনকে কখনো ‘কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন’, কখনো ‘বাতিলের দাবিতে আন্দোলন’ এমনকি ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন’ বলেও উল্লেখ করা হচ্ছে।


বিজ্ঞাপন


তবে গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নতুন যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে সেখানে এই বিভ্রান্তির নিরসন করা হয়েছে। আন্দোলনকারীরা গণমাধ্যমসহ সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, এই আন্দোলন কোটা সম্পূর্ণ বাতিলের আন্দোলন নয়, বরং কোটার যৌক্তিক সংস্কার চান তারা। ৫% কোটা রাখা যেতে পারে বলেও মত দিয়েছেন তারা।

কী বলছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা

কোটা আন্দোলনের লক্ষ্য ও শিক্ষার্থীদের চাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস দ্যুতি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আমাদের ন্যায্য ও যৌক্তিক আন্দোলন। আমরা কোনো অনৈতিক দাবি করছি না। ৫৬ শতাংশ কোটা থাকলে অনেকেই পিছিয়ে পড়বে, মেধাবীদের মেধার সঠিক মূল্যায়ন হবে না। কোটার কারণে অনেক পদে যোগ্যরা নির্বাচিত হয় না। অর্থাৎ কোটাব্যবস্থার যাঁতাকলে পিষ্ট হবে মেধাবীরা। গণতান্ত্রিক দেশে শুদ্ধ গণতন্ত্র চর্চায় নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য  লড়ার অধিকার আমাদের নিশ্চয় রয়েছে। তাই আমাদের দাবি মেধার সুষ্ঠু মূল্যায়ন করা হোক। আমরা চাই, কোটা প্রথা সংস্কার হোক।’


বিজ্ঞাপন


Kota2

একই বিভাগের ইশরাত জাহান নামে অপর এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘প্রথমত, বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মুক্তিযোদ্ধারা দেশকে স্বাধীন করেছে; সুবিধাভোগ করার জন্যে যুদ্ধ করেনি। কিন্তু এখন এই মুক্তিযোদ্ধা কোটাই আবার দেশের জনসাধারণের মধ্যে বৈষম্যের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৩০ শতাংশ কোটার কাছে মেধা পিছিয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। গণতান্ত্রিক এই দেশে বিশালসংখ্যক সাধারণ ছাত্রসমাজের এই দাবি কখনোই অযৌক্তিক হতে পারে না। মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ করা হোক। দেশে প্রতিবন্ধী কোটা এবং কিছু ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী কোটা থাকাটাই বরং অধিক যুক্তিযুক্ত। সর্বোপরি আমরা কোটা প্রথার সংস্কার চাই।’

আরও পড়ুন

কোটা আন্দোলনকারীদের ৬৫ সদস্যের সমন্বয়ক কমিটি

কোটা আন্দোলনে না যেতে ঢাবির হলে হলে ছাত্রলীগের ‘নির্দেশনা’!

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী আজিজুল হাকিম জয় ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি কোটা পুরোপুরি বাতিলের পক্ষে নই। আন্দোলনেও কিন্তু বলা হচ্ছে, ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের যে প্রজ্ঞাপন সেটি পুর্নবহাল করে সংস্কার করা হোক। সরকার চাইলেই সেটা করতে পারে, কেননা এটা রাজনৈতিকভাবে মীমাংসিত বিষয়। আদালতের কথা বলা হলেও সরকারের ক্ষমতা আছে কোটা বাতিল বা সংস্কারের। আমি চাই সংবিধান মোতাবেক শুধু পিছিয়ে পড়া বা অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য যে কোটা সেটি যৌক্তিক হারে নির্ধারণ করা হোক। ৫৬ শতাংশ কোটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ অবস্থায় দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত নানা কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে আন্দোলন চলবে।’

ঢাবি শিক্ষার্থী তাবাসসুম রশিদ বলেন, ‘আমরা ছাত্রসমাজ মনে করি বর্তমান বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ৫৬ শতাংশ কোটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, বৈষম্যমূলক এবং তা দেশের সকল মেধাবীদের সাথে উপহাসের শামিল। আমরা কোটা সম্পূর্ণভাবে বাতিল চাচ্ছি না। আমরা কোটা সংস্কার চাচ্ছি।’

Kota3

এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘কোটা মূলত প্রবর্তন করা হয়েছিল আনপ্রিভিলেজড গোষ্ঠীর জন্য, অর্থাৎ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য। যারা দুর্গম অঞ্চলে বসবাস করে, যারা শারীরিকভাবে অক্ষম তাদের জন্য কোটা রাখা যৌক্তিক। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরে এসেও মাত্র শূন্য দশমিক ২ শতাংশ জনসংখ্যার জন্য ৩০ শতাংশ মুক্তিযুদ্ধা কোটা রাখা পুরো জাতির প্রতি বৈষম্য প্রকাশ করে। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের যথোপযুক্ত সম্মান জানাই, শ্রদ্ধা করি। আমরা তাদের আদর্শ ধারণ করি। তারা একটা বৈষম্যমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যই যুদ্ধ করেছিলেন এবং দেশ স্বাধীন করেছিলেন। সে জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে ৫৬ শতাংশ কোটাব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে তাদের ভাবধারা, তাদের মূল্যবোধ, তাদের আত্মত্যাগকে অবমাননা করা হচ্ছে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের জন্য এত বিশাল পার্সেন্টেজের কোটা রাখা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। আমরা একটি বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আর এটা শুধু আমাদের আন্দোলন নয়, গোটা দেশের, গোটা জাতির অধিকার আদায়ের আন্দোলন।’

আরও পড়ুন

কোটা আন্দোলন: আদালতের বাইরে কি সমাধান সম্ভব?

কোটা আন্দোলনের পেছনে ষড়যন্ত্র থাকতে পারে, ধারণা শিক্ষামন্ত্রীর

তবে সংস্কারের পাশাপাশি সব ধরনের কোটা বাতিলও চান কোনো কোনো শিক্ষার্থী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এক শিক্ষার্থী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আসলে আপনি যখন চাকরি করতে যাবেন, দেখবেন আপনার চেয়ে কম মেধা, পরিশ্রম ও যোগ্যতা নিয়েও একজন আপনার পাশে চাকরি করছে। আবার সে যে কোটা সুবিধা পেয়েছে তা যদি মুক্তিযোদ্ধা কোটা হয়, তাহলে বড় সম্ভাবনা রয়েছে যে তার পুর্বপুরুষ আসলে মুক্তিযুদ্ধই করেনি। আমরা ইতিমধ্যে মিডিয়ায় দেখছি মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় একটা বড় অংশ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। তাই চাকরির ক্ষেত্রে আমি কোটা বাতিলের দাবি জানাই। সরকারি চাকরিতে নিয়োগের শতভাগ মেধা ও সক্ষমতার ভিত্তিতে হওয়া উচিত।’

Kota4

সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির আর্কিটেকচার বিভাগের শিক্ষার্থী প্রান্ত সিংহ বলেন, ‘পাকিস্তানিদের বৈষম্যের জন্য বাঙালিদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। অথচ সেই দেশকেই মেধাহীন সম্পদে পরিণত করছে বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতি। আমি মনে করি, প্রতিবন্ধী কোটা ব্যতীত সকল কোটা পদ্ধতি বাতিল করা প্রয়োজন৷’

অযৌক্তিক কোটা বাতিল চান আন্দোলনকারীরা

আন্দোলনের লক্ষ্য ও দাবির বিষয়ে কোটাবিরোধী আন্দোলন-২০২৪ এর অন্যতম সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসনাত আব্দুল্লাহ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা কোটা সংস্কার চাচ্ছি। সকল গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা রয়েছে তা বাতিল চাচ্ছি। সংবিধানে যাদের অনগ্রসর বা পিছিয়ে পড়া হিসেবে বিবেচনা করবে শুধু তাদের জন্য কোটা থাকতে পারবে। আমরা মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিরোধী না, কিন্তু পোষ্য কোটার বিরোধী। মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনির জন্য যে কোটা রয়েছে, আমরা তার বিরোধী। তবে সন্তানদের বিষয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। আমরা নাতি নাতনির কথা বলছি।’

‘সংস্কার নাকি বাতিল’ এ নিয়ে বিভ্রান্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা সব সময় বলছি, আমরা সংস্কার চাই বাতিল নয়। আমাদের এক দফা দাবির মধ্যে বারবার সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। আমরা কখনোই বাতিল চাইনি। আমরা বারবার এ বিষয়টি পরিষ্কার করেছি।’

এমএইচ/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর