বৈশ্বিক মহামারী করোনাকালে ২০২১ সালে দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে প্রায় ৬২ হাজার। তবে ওই বছর দেশের আলিয়া মাদরাসাগুলোতে শিক্ষার্থী সংখ্যা বেড়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ৮১৩ জন। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০২১ সালের খসড়া প্রতিবেদন থেকে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। করোনার কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা এবং অনেক অভিভাবকের আর্থিক সমস্যা, শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষেত্রে জড়িয়ে এবং ছাত্রীদের বাল্য বিবাহের শিকার হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। অন্যদিকে স্কুলের তুলনায় মাদরাসায় শিক্ষা ব্যবস্থা সহজলভ্য হওয়া মাদরাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে বলে মনে করছেন তারা। এ ছাড়াও স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কেন কমেছে আর মাদরাসায় কেন বেড়েছে এনিয়ে সুর্দিষ্ট গবেষণা করে তার সমাধান প্রয়োজন বলেও মনে করেন শিক্ষাবিদরা।
ব্যানবেইস সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ১ লাখ ৯০ হাজার ২২ জন। যা ২০২০ সালে ছিল ১ কোটি ২ লাখ ৫২ হাজারের বেশি। অর্থাৎ ২০২১ সালে ঝরে পড়েছে প্রায় ৬২ হাজার শিক্ষার্থী।
অন্যদিকে বর্তমানে দেশের আলিয়া মাদরাসাগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৬ লাখ ৫৭ হাজার ২৫২ জন। যা ২০২০ সালে ছিল ২৫ লাখ ৫৩ হাজার ৪৩৯ জন। সেই হিসাবে মাদরাসার শিক্ষার্থী বেড়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ৮১৩ জন। তবে এই সময়ে দেশের কওমি মাদরাসাগুলোতে ঠিক কতজন শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছেন সেই হিসেব নেই ব্যানবেইসের কাছে।
ব্যানবেইসের এক কর্মকর্তা জানান, এবার কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের তথ্য ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্তির কথা ছিল। কিন্তু কওমি মাদরাসা কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতার জন্য তা সম্ভব হয়নি।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরোপুরি বন্ধ ছিল। তথাকথিত ডিজিটাল প্রদ্ধতিতে ক্লাস শুরু হল। মাধ্যমিক পর্যায়ের কতজনের কাছে কম্পিউটার কিংবা অন্যান্য ডিভাইস ছিল? আসলে ডিজিটাল প্রদ্ধতি একটা প্রহসন। সব শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল প্রদ্ধতিতে লেখাপড়া করতে না পারার কারনে ঝরে পড়েছিল। এখন সরকারের উচিত যেসব শিক্ষার্থীরা ঝরে পরেছিল তাদের যেকোনো উপায়ে ফিরিয়ে আনা। কারণ শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি করতে পারেনা।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) স্পেশালিস্ট (পরিসংখ্যান) এস. এম কামরুল হাসান ঢাকা মেইলকে বলেন, করোনার কারণে অনেক পরিবারে নেমেছিল অর্থনৈতিক বিপর্যয়সহ নানা সংকট। আবার করোনার সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ ছিল। ফলে যারা স্কুল ছেড়েছিল তাদের অনেকেই করোনা পরবর্তি সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরেনি। মাদরাসার তুলনায় স্কুলে শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার সংখ্যা বেশি কেন এ নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী ঢাকা মেইলকে বলেন, করোনাকালে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার প্রধান কারণ হচ্ছে দারিদ্র্যতা। করোনার কষাঘাতে প্রায় প্রতিটি পরিবারেই নেমেছিল অর্থনৈতিক সংকট। ওই সময় পরিবারের হাল ধরতে অনেক শিক্ষার্থী উপার্জনে নেমে পড়েছিল। তারা করোনা পরবর্তী সময়ে আর স্কুলে ফিরেনি। অন্যদিকে অনেক ছাত্রীরা করোনাকালে বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছিল। তারাও আর স্কুলে ফিরেনি। শিক্ষার্থীদের এই ঝরে পড়া খুবই হতাশাজনক।
মাদরাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্কুল থেকে মাদরাসায় লেখাপড়ার খরচ কম। অনেক মাদরাসায় বোডিং কিংবা লজিংয়ে থেকে লেখাপড়া করা যায়। এছাড়াও খারাপ ছাত্ররা বেশি মাদরাসায় ভর্তি হয়। এসব কারণে মাদরাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে বলে আমার ধরণা।
স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমলেও মাদরাসায় বেড়েছে কেন? প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, এই জরিপের সঙ্গে যদি কেস ধরে একটি গবেষণা করা হত তাহলে স্কুলে শিক্ষার্থী কেন কমেছে আর মাদরাসায় শিক্ষার্থী কেন বেড়েছে তার কারণ বেরিয়ে আসত। এসব কারণ ধরে সমস্যাগুলোর সমাধাণ করা হলে স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমত না।
তিনি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন, গ্রামের অনেক অভিবাবক মনে করে দ্বীনের রাস্তায় তার সন্তানকে লেখাপড়া করানো উত্তম। এছাড়াও শহর এবং গ্রামে আনাচে-কানাতে মাদরাসার সংখ্যা বেড়েছে। মাদরাসায় লেখাপড়ার খরচও কম। অনেক মাদরাসায় এতিমখানা ও বোডিং করার কারণে দরিদ্র শিক্ষার্থীরা লেখাপড়াও সুযোগ পায়। এসব কারণে হয়ত মাদরাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। তবে ইসলামে জ্ঞানঅর্জনকে খুবই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তাই মাদরাসাগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জেনারেল শিক্ষা নিয়েও আরো গুরুত্ব দেয়া উচিত।
এসএএস/ একেবি