ছয়টি পাপড়ি ও হলুদ রঙের পরাগবিশিষ্ট মায়াময় জারুল ফুলে মোহনীয় রুপ ধারণ করেছে দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (হাবিপ্রবি)। এই ফুল যেমন আকর্ষণীয় তেমনি তার নমনীয়তা ও কোমলতা হৃদয়ে দেয় প্রশান্তির দোলা। বসন্তের মায়াময় পরিবেশ যখন সবে বিদায় নিয়েছে ঠিক তখনই নিজের আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছে ক্যাম্পাসের এই ফুলগুলো। এক পশলা বৃষ্টির পর এই ফুলের বেগুনি আভায় সৌন্দর্য যেন দ্বিগুণ বেড়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের মাঠের পশ্চিম পাশে রয়েছে মাঝারি আকারের একটি জারুল গাছ। যেনো থরে থরে সেজে আছে কোনো এক রূপকথার মায়াবী রানীর চুলের খোপা। হলের মাঠ পেরিয়ে ভূতপূর্ব ময়নাদ্বীপের রাস্তাটা ধরে এগুতে থাকলেই চোখে পরবে ৩টি জারুল গাছের। যেনো একসাথে প্রেমময় করে তুলেছে ফিশারিজ পুকুরঘাটকে। শেষ বিকেলে গ্রীষ্মের তাপ কিছুটা কমলে বন্ধুবান্ধবদের দেখা মেলে ঝড়ে পরা বেগুনীর আভায় আড্ডা দিতে।
বিজ্ঞাপন
ইতিহাসে বেগুনী আর রক্তবর্ণ আভিজাত্য এবং মর্যাদার প্রতীক হয়ে ছিল। রোমের সম্রাটরা রক্তবর্ণের আলখেল্লা পরিধান করতেন, যা বাইজেন্টাইন সম্রাটরাও পরতেন। মধ্যযুগে বিশপ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসররা বেগুনী বস্ত্র পরিধান করতেন। বিভিন্ন চিত্রকর্মেও কুমারী মেরির পোশাকের রঙ বেগুনী দেখানো হয়েছে। ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের কিছু জরিপ থেকে জানা যায়, বেগুনীকে অনেকেই অপব্যয়, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, রীতিবিরুদ্ধ, কৃত্রিম এবং অস্পষ্টতার বর্ণ বলে মনে করে। বসন্তের দখিনা হাওয়ায় শিমুলের লাল ঝড়ে গেলেও গ্রীষ্মের গরমে এক পশলা বৃষ্টিতে চকচক করে ওঠা বেগুনী জারুল যেনো নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটায়। মেলে দেয় নিজের সব সৌন্দর্য। কচি সবুজ পাতার ফাঁকে-ফাঁকে উঁকি মারে বেগুণি-হলুদ জারুল ফুল।
সূর্য তখন মাথার উপরে কিরণ দিচ্ছে। দেখা মিললো গ্রীষ্মের তপ্ত রোদে ক্লান্ত কিছু শ্রমিককে ফিশারিজ পুকুরপাড়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন জারুলের ছায়ায়। সঞ্চয় করছেন কাজের শক্তি এবং মনোবল। সেন্ট্রাল মসজিদের রাস্তাটা ধরে হাঁটতে বেরিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের কিছু শিক্ষার্থী। প্রতিবেদককে দেখে তারা বলেন, স্নিগ্ধ সকাল হোক কিংবা তপ্ত দুপুর, পথচারীরা রাস্তায় হাঁটবে আর এই গাছগুলো তাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করবে না তা যেন হওয়ার নয়। এমনই এক সম্মোহনী শক্তি নিজের মধ্যে পুঞ্জীভূত করে রেখেছে জারুল ফুল। রোদ বেশি থাকায় বিকেলে বঙ্গবন্ধু হল মাঠে মাঝারি আকারের সেই জারুল গাছের সাথে ছবি তোলার আলাপও চলে তাদের মাঝে।
অডিটোরিয়াম-১ এর সামনেসহ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আরও কয়েকটি যায়গায় দেখা মেলে ভেষজ ঔষধী গুণসম্পন্ন উজ্জ্বল বেগুনি আভার জারুল গাছের।
বাংলার চেরি খ্যাত এই ফুলের ইংরেজি নাম ‘প্রাইড অব ইন্ডিয়া’। বৈজ্ঞানিক নাম লেজারস্ট্রমিয়া স্পেসিওসা। জারুলের রঙে মুগ্ধ হয়ে কবি আহসান হাবিব তাঁর স্বদেশ কবিতায় লিখেছিলেন— ‘মনের মধ্যে যখন খুশি এই ছবিটি আঁকি, এক পাশে তার জারুল গাছে দুটি হলুদ পাখি।’
উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা বলছেন, জারুলের আদি নিবাস শ্রীলঙ্কায় হলেও এটি ভারতীয় উপমহাদেশের নিজস্ব বৃক্ষ। বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও চীন, মালয়েশিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে জারুলগাছের দেখা মেলে। জারুল ফুলের গাছ সাধারণত ১০ থেকে ১৫ মিটার উঁচু হয়ে থাকে। গ্রীষ্মের শুরুতেই এর ফুল ফোটে এবং শরৎ পর্যন্ত দেখা যায়। ফুল শেষে গাছে বীজ হয়। বীজ দেখতে গোলাকার। জারুল বীজের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে। বাংলাদেশে সাধারণত নীলাভ ও গোলাপি এই দুই রঙের জারুল ফুল দেখা যায়। জারুলগাছের বীজ, ছাল ও পাতা ডায়াবেটিস রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ ছাড়া জ্বর, অনিদ্রা, কাশি ও অজীর্ণতার চিকিৎসায়ও জারুল যথার্থ উপকারী।
বিজ্ঞাপন
নানাবিধ ভেষজ গুণসম্পন্ন উজ্জ্বল বেগুনি আভার জারুল ফুলের বাহারি পসরা যেন হাবিপ্রবির আঙিনাকে এনে দিয়েছে মুগ্ধতার ছোঁয়া। ঈদের ছুটি শেষে যেনো বেগুনি ফুলে স্বাগত জানাচ্ছে এই জারুল গাছগুলো।
এএ

