আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রকৃতি ও পরিবেশ বান্ধব ‘গ্রিন বিল্ডিং’ তৈরির পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) ও ইনফরমেশন টেকনলোজি (আইটি) বিষয়ে গুণগতমান, সম-সুযোগ এবং দক্ষতার বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যবহৃত হবে এই ভবন ।
দেশে গার্মেন্টস সেক্টরে এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন গ্রিন বিল্ডিংয়ের নজির থাকলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রিন বিল্ডিংয়ের নজির নেই । ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এটিই হবে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম কোনো গ্রিন বিল্ডিং।
বিজ্ঞাপন
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন এই ভবনে আধুনিক সুবিধাসম্বলিত বিভিন্ন ল্যাবের ব্যবস্থা থাকবে। বিভাগের ব্যবহারের জন্য থাকবে উন্নতমানের কম্পিউটার সামগ্রী, ইকুইপমেন্ট এবং টিচিং অ্যান্ড লার্নিং মেটেরিয়ালস। গবেষণা পরিচালনার জন্য থাকবে ফান্ড। সিএসই এবং আইটি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের জন্য থাকবে স্কলারশীপ, ফেলোশী, স্টাইপেন্ড এবং এওয়ার্ড প্রোগ্রাম। দেশীয় পরামর্শকের পাশাপাশি নিয়োগ দেওয়া হবে আন্তর্জাতিক ভিজিটিং প্রফেসর ।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র বলছে, পরিকল্পিত নতুন ভবনের নাম হবে ‘আইটি হাব’। ইতোমধ্যে আইটি হাবের জন্য স্থান নির্বাচন করেছে ঢাবি কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের পেছনে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীদের কোয়াটারের স্থানেই নির্মিত হবে এই গ্রিন বিল্ডিং।
বিশ্বব্যাপী গ্রিন বিল্ডিংয়ের স্ট্যান্ডার্ড মান নির্ধারণে কাজ করে বিভিন্ন সংস্থা। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউএসজিবিসি) লিডারশিপ ইন এনার্জি এন্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন (এলইইডি) বা 'লিড'। এই প্রতিষ্ঠানটি ভবন তৈরিতে বিভিন্ন শর্তাদি আনুপাতিকহারে পূরণ সাপেক্ষে নির্দিষ্ট পয়েন্টের ভিত্তিতে চার ক্যাটাগরিতে সনদ সরবরাহ করে থাকে । মোট ১০০ পয়েন্টের মধ্যে ৪০ থেকে ৪৯ পয়েন্ট পেলে বেসিক সনদ, ৫০ থেকে ৫৯ পয়েন্ট পেলে সিলভার সনদ, ৬০ থেকে ৭৯ পয়েন্ট সংগ্রহ করতে পারলে গোল্ড সনদ এবং ৮০ থেকে এর ওপরের পয়েন্টে প্লাটিনাম সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। সর্বনিম্ন ১০০০ বর্গফুটের যেকোনো ভবন নির্মাণে লিড সার্টফিকেশনের জন্য আবেদন করা যায়।
বিজ্ঞাপন
সংশ্লিষ্টরা জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসজিবিসি পরিচালিত লিড সার্টিফিকেশনের গোল্ড সনদ পাওয়ার লক্ষমাত্রা নিয়ে গড়ে তোলা হবে এই ভবন । ফলে আইটি হাবে একটি গ্রিন বিল্ডিংয়ের প্রায় সব সেবার উপস্থিতিই থাকবে ।
যেসব নতুনত্ব থাকবে এই গ্রিন বিল্ডিংয়ে:
এই অবকাঠামোতে ব্যবহৃত সকল উপকরণগুলোই হবে পুনঃব্যবহারযোগ্য এবং পরিবেশবান্ধব। প্রকৃতির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে অতিরিক্ত জ্বালানি অপচয় রোধ করা হবে ভবনটিতে। এই প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ শক্তি কম ব্যবহার করে প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। ফলে নিয়ন্ত্রণে থাকবে বিদ্যুৎ খরচ ও কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ। এই ভবনে বিশেষ কায়দায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে রেখে টয়লেটের ফ্লাস, গার্ডেনিং, কার ওয়াসসহ অগ্নিনির্বাপণের ব্যবহার করা হবে।ভবনের ছাদে লাগানো থাকবে উন্নত প্রযুক্তির সোলার সিস্টেম, যা বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সাহায্য করবে। তাছাড়া নিয়ম অনুযায়ী অবকাঠামোর ৪০ শতাংশ মুক্ত থাকায় দিনের বেলায় অনেকাংশে বিদ্যুৎ খরচ কমে যাবে ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পের দায়িত্বে নিয়োজিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ড. কাজী মুহাইমিন উস সাকিব বলেন, দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেও শিক্ষার্থীরা চাকরিদাতা কারপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে অদক্ষ হিসেবে গণ্য হচ্ছে । এর একটি বড় কারণ, শিক্ষার্থীদের আইটি সেক্টরে পর্যাপ্ত দক্ষতা না থাকা । বিভিন্ন সামীক্ষা ঘাটলেই দেখা যায় দেশের শতকরা ৩০ শতাংশেরও বেশি নিয়োগকারী সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দেশের স্নাতকদের দক্ষতা নিয়ে সন্তুষ্ট নয় । ফলে এ খাতে অনেক ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো হতে উচ্চ বেতনে কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে তারা। বৈশ্বিক পরিমন্ডলে ও শিল্পে দ্রুতগতিতে গবেষণা ও উন্নয়ন চলমান রয়েছে । কিন্তু বাংলাদেশে এ বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে শিল্প খাতের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সহযোগিতামূলক সম্পর্ক দুর্বল। এ শিল্পের বিকাশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা সক্ষমতা বৃদ্ধি করাসহ বিভিন্ন খাতে শিক্ষার্থীদের দক্ষ মানবসম্পদে গড়ে তোলার জন্যই এই আইটি হাব। আইটি খাতে শিক্ষার্থীদের দক্ষ ও অভিজ্ঞ হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি উদ্যোক্তা হতেও সকল ধরণের সাহায্য সহযোগিতা করবে এই প্রতিষ্ঠান ।
মূলত, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের আওতায় বাস্তবায়নাধীন ”ইম্প্রুভিং কম্পিউটার অ্যান্ড সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং টারশিয়ারি এডুকেশন” শীর্ষক প্রকল্প দেশের মোট তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক সুবিধা সম্পন্ন এমন ভবন তৈরি করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য দুটি বিশ্ববিদ্যালয় হলো- বাংলদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি) । তবে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইট হাবের জন্যই তৈরি করা হবে গ্রিন বিল্ডিং। সম্মিলিত এই প্রকল্পে ব্যায় ধরা হয়েছে ১ হাজার ২১৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা। চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) কর্তৃক অনুমদিত হয়। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের মার্চ মাস থেকে শুরু করে শেষ হবে ২০২৮ সালের জুন মাসে। তবে প্রকল্পের মূল ঋণদাতা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এখনো ঋণের চুক্তিতে সই করেনি ।
এ বিষয়ে জনতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, এটি হবে অত্যাধুনিক ভবন। আমরাই প্রথম কোনো বিশ্ববিদ্যালয়, যারা শিক্ষার্থীদের জন্য এমন গ্রিন বিল্ডিং তৈরি করতে যাচ্ছি ।
এমএইচএম