শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

বেধড়ক পিটুনি, ‘জীবনভিক্ষায়’ বেঁচে ফিরলেন ঢাবি ছাত্র

এম এইচ ইমরান, ঢাবি
প্রকাশিত: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৩:৩১ পিএম

শেয়ার করুন:

বেধড়ক পিটুনি, ‘জীবনভিক্ষায়’ বেঁচে ফিরলেন ঢাবি ছাত্র

বন্ধুর অপমানের প্রতিবাদ করতে গিয়ে দোকানি এবং স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতাদের হাতে বেধড়ক মার খেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থী। তাদের একজনকে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতার কাছে জীবনভিক্ষা চেয়ে বেঁচে ফিরতে হয়। গুরুতর অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

গতকাল শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) রাত ৭টায় রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় রবীন্দ্র সরোবরে এই ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত আটজন শিক্ষার্থী আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।


বিজ্ঞাপন


আহতদের মধ্যে মাহফুজুর রহমান আলিফ নামের বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবটিক্স অ্যান্ড মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক শিক্ষার্থীর অবস্থা আশঙ্কাজনক। তার মাথা, পিঠ, কাঁধসহ পুরো শরীরে জখমের চিহ্ন রয়েছে। তার মাথায় সাতটা সেলাই দেওয়া হয়েছে। দায়িত্বরত চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তাকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। ঘটনায় আহত অন্যদের প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয়।

‘মনে হচ্ছিল আর বাঁচব না’    

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মাহফুজুর রহমান আলিফ বলেন, বন্ধুকে অপমানের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হই। আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি ৪০-৫০টি মোটরসাইকেল সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা যাওয়ার সাথে সাথে তারা অতর্কিত হামলা করে। তখন আমাদের সবাই এদিক-ওদিক পালাতে থাকে। কিন্তু আমি দৌড়ে পালাতে গিয়ে পড়ে যাই। ১০-১২ জন আমাকে একসাথে মারা শুরু করে। তখনই লাঠি-রডের আঘাতে আমার মাথা ফেটে যায়। আমার মাথা, পুরো শরীরে লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়।

আলিফ বলেন, তারা আমার পাঞ্জাবি ছিঁড়ে ফেলে। আমি উঠে দৌড় দিই। কিন্তু তারা আমার পেছনে ধাওয়া করে। আমি দৌড়ে রবীন্দ্র সরোবর থেকে ধানমন্ডি লেক রোড ব্রিজে উঠি। আমার মনে হচ্ছিল, আর বাচঁবো না। আরেকটা মারলে ঘটনাস্থলেই মারা যাবো। তখন আমি প্রাণ বাঁচার তাগিদে ব্রিজের উপর থেকে লেকে লাফ দিই। পানিতে লাফ দেওয়ার পর তারা উপর থেকে তাদের হাতে যা ছিল সব ছুড়ে মারে। চারদিক থেকে ঢিল ছোড়াছুড়ি করতে থাকে।


বিজ্ঞাপন


ঢাবি শিক্ষার্থী বলেন, আমি লেকের এপাড় থেকে ওপাড় যেতে থাকি। কিন্তু যে পাড়েই যাই তারা ওপাড়ে লাঠিসোটা নিয়ে এসে দাঁড়ায়। মনে হচ্ছিল, আমি পানিতেই মরে যাব। তখন নিজের জীবনের কথা চিন্তা করে পুকুর থেকে তাদের কাছে মিনতি করি- ‘ভাই! আমাকে আর মারলে আমি মরে যাব। আমাকে মাফ করে দিন।’ তারপরও কেউ শুনল না। তারা তখনও ঢিল ছুড়েই যাচ্ছে। আমি তখন পাড়ের দিকে যাচ্ছিলাম ক্ষমা চাওয়ার জন্য। আমি বলছিলাম- ভাই! আমাকে মাফ করে দিন। কিন্তু এবার তারা পানিতে নামতে থাকে আমাকে মারার জন্য। আমি আবার লেকের মাঝখানে চলে যাই।

আলিফ বলেন, পরে একজন এগিয়ে এসে বলেন যে, চলো, তোমাকে ওই পাড়ে নিয়ে যাই। আমাদের ওখানে নেতা আছে। উনার কাছে মাফ চাইবে তুমি। তাহলে হয়ত তুমি বাঁচতে পারবে। আমি বললাম- ভাই! আমি এখন ওপাশে গেলে পানিতে ডুবে মারা যাব। তারপর তিনি পানিতে নেমে আমাকে ওইপাশে নিয়ে যান। ওখানে স্থানীয় বেশ কয়েকজন নেতা বসে ছিলেন। তখন আমি গিয়ে এক রকম তাদের পায়ে ধরে ক্ষমা চাই। বলি- ‘ভাই! আমি মরে যাচ্ছি। আমাকে বাঁচান।’ তখনও তারা আমার পেছনে লাথি, কিল, ঘুসি মারছিল। এই অবস্থায় পুলিশ এসে আমাকে গাড়িতে তুলে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়।  

ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে

ঘটনার সূত্রপাত বন্ধু এবং তার মেয়ে বান্ধবীকে অপমান করাকে কেন্দ্র করে। ঘটনার বর্ণনায় ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করে বলেন, আমরা প্রথমে হল থেকে জানতে পারি- নাসিফ নামের আমাদের  এক বন্ধুকে অপমান করেছে স্থানীয় দোকান কর্মচারীরা। এরপর আমরা হলের ছয় বন্ধু মিলে একসাথে ওখানে উপস্থিত হই। আমরা দোকানে গিয়ে  ওই লোকটাকে বের হতে বলি। এক পর্যায়ে জোর করে বাইরে আনার চেষ্টার সময় দোকানের অন্যান্য কর্মচারীরাসহ আশপাশের দোকানের লোকেরা আমাদের এলোপাতাড়িভাবে মারা শুরু করে। তারা আমাদের  দুই বন্ধুকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেয়।

এই শিক্ষার্থী বলেন, আমরা তখন একরকম ওখান থেকে পালিয়ে আসি। ঘটনার বিস্তারিত খবর হলের রাজনৈতিক বড় ভাইসহ বন্ধু-বান্ধবদের জানাই। খবর পেয়ে আমাদের আরও কিছু বন্ধুবান্ধব ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হন। আমরা তখন প্রায় ২৫ জনের মতো। আমাদের হাতে কিছু লাঠিসোঁটা ছিল। সেখানে যাওয়া মাত্রই স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতারা আমাদের উপর আক্রমণ করেন। তারা সবাই লাঠি, হাতুড়ি, রড দিয়ে আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। আমরা এলোমেলোভাবে পালানো শুরু করি। তারাও আমাদের পেছনে পেছনে ধাওয়া করে করে মারতে থাকে। আমাদের অনেকের মানিব্যাগ, মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এতে আমাদের অন্তত আটজন মাথায়, পিঠে, কাঁধে আঘাত পায়। 

এ প্রসঙ্গে ধানমন্ডি জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) আবু তালেব ঢাকা মেইলকে বলেন, ঘটনার শুরু হয় বিকেলের দিকে। কয়েকজন শিক্ষার্থী ধানমন্ডি লেকের এক রেস্টুরেন্টে খাবার অর্ডারকে কেন্দ্র করে এই ঘটনার সূত্রপাত। অর্ডার দিয়ে তারা সেখানে তাস খেলতে বসে। পরে সেখান থেকে তাদের সরে যেতে বলায় বাকবিতণ্ডা হয়। এরপর বিষয়টা আবার মীমাংসা হয়। এই বিষয়টা ঢাবির অন্য শিক্ষার্থীরা জানার পর তারা এসে সংঘর্ষে জড়ায়। এতে আটজন আহত হয়েছেন।

পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত আটক নেই। আমাদের কাছে কেউ লিখিত অভিযোগ দেয়নি। আর সংঘর্ষের পর আমরা ঘটনাস্থলে যাই এবং বিষয়টা নিয়ে কাজ শুরু করি।

এবিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাকসুদুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা স্থানীয় ছাত্রলীগ এবং ঘটনায় জড়িত থাকা সবার সঙ্গে বসার ব্যবস্থা করছি। তবে এবিষয়ে এখনো প্রশাসনিকভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। দুই পক্ষের আলোচনার পরেই সিদ্ধান্ত হবে।

প্রতিনিধি/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর