বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

ব্যবসায়ীদের লাভ-লালসায় অসহায় ভোক্তা!

ঢাকা মেইল ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৪ মার্চ ২০২৩, ১০:৫৫ পিএম

শেয়ার করুন:

ব্যবসায়ীদের লাভ-লালসায় অসহায় ভোক্তা!

প্রথম রমজানে এবারও দ্রব্যমূল্যের তাপে নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তরা অসহায়৷ দেশে রমজান মাসেও কেন পণ্যের দাম হু হু করে বাড়ে? সরকার, দেশের আইন, ধর্মের কথা - সবই কি ব্যবসায়ীদের লাভ-লালসা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ?

সরকারের বিভিন্ন দফতর ব্যবসায়ীদের নানা সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও তাতে দৃশ্যত কোনো কাজই হয়নি৷ রোজার প্রথম দিনে নানা পণ্যের দাম আরেক দফা বেড়েছে৷ ভোক্তা অধিদফতরের মহাপরিচালক অবশ্য আশা করছেন, পণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সেগুলোর সুফল দুই-একদিনের মধ্যেই পাওয়া যাবে৷


বিজ্ঞাপন


প্রথম রোজার দিনে ঢাকায় ব্রয়লার মুরগির কেজি ২৯০ টাকা আর গরুর মাংসের কেজি ৮০০ টাকায় উঠে গেছে৷ গত এক মাস ধরে ব্রয়লার মুরগির দাম নিয়ে কথা হয়েছে সবচেয়ে বেশি৷

এ বিষয়ে জার্মানভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলে মসজিদের কয়েকজন ইমামের সঙ্গেও কথা বলেছে, জানতে চেয়েছে রমজানে দ্রব্যের দাম লাগামছাড়া হওয়ার বিষয়ে তারা কী ভাবেন, মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যবসায়ীদের প্রতি ধর্মীয় দৃষ্ঠিকোণ থেকে তাদের কোনো পরামর্শ থাকে বা আছে কি না৷ তারা ডয়চে ভেলেকে বলেন, দাম বাড়ানোর এই প্রতিযোগিতা রোজার সংযমের যে নীতি তার বিরোধী৷ এটা অন্যায়৷

প্রথম রোজা শুক্রবারে হওয়ায় জুমার নামাজের খুতবায় এসব কথা বলেছেন বলেও জানান তারা৷ তবে ইমামরা মনে করেন, সরকারের দিক থেকেও মসজিদে এ ব্যাপারে কথা বলার আহ্বান জানানো হলে আরও বেশি ভালো হতো৷

ভোক্তা এবং ভোক্তা অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের কোনো উদ্যোগই তেমন কোনো কাজে আসছে না৷ ‘চোর’ ধর্মের কাহিনি শুনছে না৷ তারা মনে করেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রয়োজন দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা৷


বিজ্ঞাপন


রোজার প্রথম দিনে বাজারে গিয়েছিলেন সাব্বির আহমেদ৷ সকালে গিয়েছিলেন কারওয়ান বাজারে৷ ভেবেছিলেন মহল্লার বাজারে না গিয়ে কারওয়ান বাজারে গেলে বাড়তি দাম দিতে হবে না৷ কিন্তু তার আশা পূরণ হয়নি৷ তিনি বলেন, ‘৭৫০ টাকা কেজিতে গরুর মাংস পাওয়া যায়: কিন্তু তা হিমায়িত বা অনেক দিন আগে ফ্রিজে রাখা মাংস৷ সদ্য জবাই করা গরুর মাংসের কেজি ৮০০ টাকা৷ ব্রয়লার মুরগি একদিন আগেও ছিল ২৮০ টাকা কেজি, কিন্তু রোজার প্রথম দিনে হয়েছে ২৯০ টাকা৷ একইভাবে শশা, কাঁচা মরিচ, টমেটো, বেগুন, শাক-সবজি, মাছ- সব কিছুর দামই একদিনের ব্যবধানে কেজিতে পাঁচ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে৷ এমনকি একদিন আগে একটি বড় মাছ কাটতে নেওয়া হতো ১০ টাকা, প্রথম রোজায় নেওয়া হয়েছে ২০ টাকা৷ সবকিছুর দাম যেন প্রতিযোগিতা করে বাড়ানো হচ্ছে৷’

ফলের দামও এক দিনের ব্যবধানে অনেকটা বেড়েছে৷ ৬০ টাকা কেজির কাজি পেয়ারা প্রথম রোজায় হয়েছে ৮০ টাকা৷ সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘আমি পেয়ারা বিক্রেতার কাছে জানতে চাই- এক রাতে পেয়ারার দাম কেজিতে ২০ টাকা কীভাবে বাড়ে? জবাবে তিনি বলেন, এক রাতে অনেক কিছুই হয়ে যেতে পারে৷ দাম বাড়ার জন্য এক রাতই যথেষ্ট৷’

ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই দ্রব্যমূল্য বেড়েছে৷ বাংলাদেশে গত এক বছরে সেই বৃদ্ধিটা হয়েছে প্রায় অবিশ্বাস্য মাত্রায়৷ গত বছর এই সময়ে এক কেজি খোলা চিনির কেজি ছিল ৮০ থেকে ৮৫ টাকা, এবার বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়৷ গত বছর খোলা সয়াবিন তেলের লিটার ছিল ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা, এবার দাম ১৭২ টাকা৷ গত বছর ছোলার কেজি ছিল ৮০ থেকে ৮৫ টাকা, এবার ১০০ টাকা৷ গত বছর রোজার শুরুতে ব্রয়লার মুরগির কেজি ছিল ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা, এবার হয়েছে ২৯০ টাকা৷ গরুর মাংস ছিল ৬৫০ টাকা, এবার ৮০০ টাকা কেজি৷ খাসির মাংস গত বছর কেজি ছিল ৮০০ টাকা, এবার  এক হাজার ১০০ টাকা৷

গত বছর এই সময়ে ছোট পাঙাশ মাছ কেজি ১২০ থেকে ১৩০ টাকায় পাওয়া যেতো, সেটা এখন কিনতে হচ্ছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকায়৷ রুই মাছ গত বছর ছিল ২২০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি, এবার বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায়৷

এদিকে পরিস্থিতি সামাল দিতে পোল্ট্রি খাতের বড় চারটি প্রতিষ্ঠান সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তারা খামার পর্যায় থেকে ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ১৯৫ টাকার বেশি দিয়ে কিনবে না৷ সেই হিসেবে ব্রয়লার মুরগির দাম খুচরা বাজারে ২৪০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়৷ কিন্তু তা এখনো হয়নি৷ তবে পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, ‘‘মূল সমস্যা কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের মধ্যে৷ তারা আসলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে৷ সিন্ডিকেট করে৷ তারা গত ৫২ দিনে বাজার থেকে ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে৷ খামারিরা কিছু পায়নি৷ এবারও তারাই ব্যবসা করবে৷’’

আর ভোক্তা অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘বাজারে ব্রয়লার মুরগির দাম অবশ্যই কমবে, তবে সময় লাগবে৷’

নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে এখন ব্যবসায়ীরাই একে অপরকে দুষছেন৷ এফবিসিসিআইর সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন প্রশ্ন তুলেছেন দুবাইয়ে এক কেজি গরুর মাংস ৫০০ টাকা, বাংলাদেশে ৭৫০ টাকা কেন? তিনি বৃহস্পতিবার ব্যবসায়ীদের এক সভায় এই প্রশ্ন করেন৷ তিনি ব্রয়লার মুরগির কেজি ২৮০ টাকাও অস্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেন৷ সরকার চাইলে তারা আমদানি করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করায় ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত বলেও জানান তিনি৷

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদশ (ক্যাব)-এর সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘এই পরিস্থিতির জন্য প্রধানত ব্যবসায়ীরাই দায়ী৷ তারা সিন্ডিকেট করে সব কিছুর দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে৷ রোজাকে তারা দাম বাড়ানোর একটা মৌসুম হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন৷ আর সরকার যা-ই বলুক না কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না৷ ঠিকমতো মনিটরিং করা হচ্ছে না৷ সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো দায়িত্ব পালন করছে না৷’

রোজার প্রথম দিন শুক্রবার হওয়ায় জুমার নামাজের খুতবায়ও বাজার দরের প্রসঙ্গ উঠে আসে৷ মোহাম্মদপুর হাজি মফিজুর রহমান সাদ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব মুফতি গাজী সানাউল্লাহ রহমানি বলেন, ‘রমজান হলো সংযমের মাস৷ সব ধরনের সংযম পালন করতে হবে মুসলমানদের৷ এই রমজানে দ্রব্যমূল্য বাড়ানোর যে প্রবণতা, এটা রমজানের শিক্ষার পরিপন্থী৷ তাই আমরা খুৎবায় এটা বলেছি৷ বলেছি ব্যবসায়ীদের দ্রব্যমূল্য না বাড়াতে৷’

আরেক প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, ‘সরকারও মসজিদকে কাজে লাগাতে পারে৷ এই ধরনের বিষয়ে কথা বলার জন্য মসজিদের ইমামদের আহ্বান জানাতে পারে৷ তাহলে এটা আরও বেশি কার্যকর হতে পারে৷’

আর ভোক্তা অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, ‘এবার বাজার মনিটরিংয়ের ওপর আমরা সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছি৷ এজন্য বাজার কমিটিকেও আমরা সাথে রেখেছি৷ কেউ যেন বাজারে সংকট তৈরি করতে না পারে, সরবারাহ বিঘ্নিত করতে না পারে, কৃত্রিম ভাবে দাম বাড়াতে না পারে তা আমরা দেখবো৷’

‘এর বাইরে আমাদের ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান শুরু করেছে ঢাকা শহরে৷ সরকারের অন্যন্য সংস্থাও কাজ করছে৷ কাজ করছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী,’ জানান এই কর্মকর্তা৷ সূত্র: ডয়চে ভেলে

জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর