শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

পর্যাপ্ত মজুদের পরও ‘টেনশন’ কেন?

বোরহান উদ্দিন
প্রকাশিত: ১৭ মার্চ ২০২৩, ০২:১১ পিএম

শেয়ার করুন:

পর্যাপ্ত মজুদের পরও ‘টেনশন’ কেন?

রমজান-নির্ভর ভোগ্যপণ্যের বেশিরভাগই আমদানি করতে হয়। মাঝে ডলার সঙ্কটসহ নানা কারণে ব্যবসায়ীরা আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়লে পাশে দাঁড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। রমজানে ছোলা, খেজুর, চিনি ও পেয়াজসহ অতিপ্রয়োজনীয় ৮ পণ্য বাকিতে আমদানির সুযোগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

গত ডিসেম্বরে এই সিদ্ধান্তের পর প্রায় তিনমাস হতে চলছে। এরইমধ্যে আমদানি করা সেসব পণ্য দেশে পৌঁছার কথা। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, রমজানে বেশি ব্যবহার্য সব পণ্যের যথেষ্ট মজুত আছে, যা আগের বছরের তুলনায় বেশি। তবুও প্রতি বছরের মতো এবারও রমজান ঘিরে অস্থির হচ্ছে নিত্যপণ্যের বাজার। নির্ধারিত দামে মিলছে না বেশিরভাগ পণ্য।


বিজ্ঞাপন


ক্রেতাদের দুশ্চিন্তা, রোজায় ন্যায্যমূল্যে পণ্য মিলবে কিনা? আর খুচরা দোকানিদের ভাবনা, ডিলারদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত মালামাল মিলবে কিনা।

যদিও গত মাসে সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, রমজানে সরবরাহের জন্য ২০ হাজার টন চিনি, ৪০ হাজার টন মসুর ডাল, ৪ কোটি লিটার সয়াবিন তেল, ১ হাজার ১০০ টন খেজুর, ১০ হাজার টন ছোলার প্রয়োজন হবে। এরই মধ্যে এসব পণ্য আমদানি করা হয়েছে।

Specialএছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে নিত্যপণ্যের অবৈধ মজুত কিংবা দাম বাড়ালে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হচ্ছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের পাশাপাশি দেশজুড়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সিদ্ধান্ত আছে। একইসঙ্গে বাজার মনিটরিংয়ে মাঠে থাকার কথা জানিয়েছে পুলিশ বিভাগও।

তবে বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যবসায়ীদের মধ্যে অতি মুনাফা লাভের অসুস্থ প্রতিযোগিতা, বছরজুড়ে বাজারে সরকারের কঠোর নজরদারি না থাকার কারণেই এমন পরিস্থিতির তৈরি হচ্ছে।


বিজ্ঞাপন


অবশ্য ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর নেতাদের দাবি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি যখন টালমাটাল তখন এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। বিশেষ করে ডলার সঙ্কটের কারণে আমদানি কমে যাওয়া, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় তারাও বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।

এদিকে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির তথ্য এরইমধ্যে উঠে এসেছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক পরিসংখ্যানে। সংগঠনটি বলছে, গত একবছরে শুধু ঢাকা মহানগরে নিত্যপণ্য ও সেবার দাম ১১ শতাংশ বেড়েছে। সার্বিকভাবে পণ্য ও সেবার গড় দাম বেড়েছে ১১ শতাংশের কিছু বেশি। খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ১০ শতাংশের মতো। আর খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম বেড়েছে ১২ দশমিক ৩২ শতাংশ।

কোন পণ্যের কি হাল?

দেশে প্রতি মাসে গড়ে ছোলার চাহিদা ১০ হাজার টন। কিন্তু রমজানে এই চাহিদা ১০ থেকে ১২ গুণ বেড়ে হয় ১ লাখ থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টন। এই তথ্য অনুযায়ী বছরে দেশে ছোলার চাহিদা ২ লাখ থেকে ২ লাখ ২০ হাজার টন। বার্ষিক চাহিদার বিপরীতে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে ২ লাখ ৬০ হাজার ২৪০ মেট্রিক টন ছোলা আমদানি হয়েছে বলে জানা গেছে।

Specialতারপরও ছোলার দাম বাড়তে শুরু করেছে। মানভেদে প্রতি কেজি ছোলা এখন বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকা। রমজানের সময় আরও বাড়ার আশঙ্কা আছে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, গত এক মাসে ছোলার দাম প্রায় ৬ এবং এক বছরে ২৩ শতাংশ বেড়েছে। এ ছাড়া অ্যাঙ্কর ডালের দাম এক বছরে কেজিতে দাম বেড়েছে প্রায় ৪৮ শতাংশ।

চিনি নিয়ে সঙ্কট রয়েই গেছে

দেশে চিনি উৎপাদিত হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টন। আর বছরে আমদানি হয় ২১ লাখ টনের মতো। অর্থাৎ চিনির বাজার পুরোপুরি আমদানি-নির্ভর। দীর্ঘদিন চিনির দাম মোটামুটি সহনীয় থাকলেও কয়েকমাস ধরে তা আকাশচুম্বী হয়ে গেছে। সরকারি হিসাবে গত এক বছরে চিনির দাম প্রায় ৪৯ শতাংশ বেড়েছে।

তথ্য মতে, গত ছয় মাসে চারবার দাম বাড়ানোর পরও চিনির বাজারে স্বস্তি নেই। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে আমদানিকারকদের দাবির মুখে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চিনি আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশে নামিয়েছে। একই সঙ্গে প্রতি টন অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে তিন হাজার টাকা এবং পরিশোধিত চিনিতে ছয় হাজার টাকা শুল্ক প্রত্যাহার করেছে।

Specialআমদানিকারক ও বাজারজাতকারীদের তথ্যমতে, শুল্ক ছাড়ের এই সুবিধার আওতায় চিনি আমদানি হলে কেজিতে ৫ থেকে সাড়ে ৫ টাকা পর্যন্ত দাম কমতে পারে।

খেজুরেও স্বস্তি নেই

টিসিবির তথ্য বলছে, খেজুরের দাম এক বছরে বেড়েছে ২০ শতাংশ। টিসিবির সাশ্রয়ী খেজুরের দামও কেজিতে ২০ টাকা বাড়ানো হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ৯০ হাজার ৪০৫ মেট্রিক টন খেজুর আমদানি হয়েছে। গত সাত মাসে (জুন থেকে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত) ৩০ হাজার ৯১১ মেট্রিক টন খেজুর আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে নভেম্বর, ডিসেম্বর মাসে।

Specialভোক্তা অধিকার বলছে, গতবারের তুলনায় পণ্যটি ৩১ শতাংশ কম আমদানি করা হয়েছে। বিদ্যমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে পণ্যের দাম ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ার আশঙ্কা করছে সংস্থাটি।

সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশে রমজান মাসে চাহিদা বাড়ে এমন সব পণ্যের দাম গত বছরের তুলনায় এ বছর ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বাড়তি থাকবে। আন্তর্জাতিক বাজারে গত বছরের দামের সঙ্গে এ বছরের দাম যদি এক হয়, তারপরও ডলারের এক্সচেঞ্জ রেটের কারণে পণ্যের দাম ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি হবে।

তেল নিয়ে ‘দুশ্চিন্তা’ কাটেনি

সয়াবিন তেলের বাজার অনেকদিন ধরেই অস্থির। বাজার থেকে তেল উধাও হওয়ার ঘটনাও আছে। মিল ও ব্যবসায়ীদের বাসা-বাড়িতে অভিযানের ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু কোনো উদ্যোগেই কাজ হয়নি। এখনো বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে রান্নার অন্যতম অনুষঙ্গ সয়াবিন তেল।

দেশে ১৮ থেকে ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে তিন থেকে চার লাখ টন তেলের দরকার হয় রমজানে।

Specialগত ১৫ ডিসেম্বর বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে ৫ টাকা কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ফলে তেল ১৮৭ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে। তাও প্রয়োজন অনুযায়ী মিলছে না।

খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৬৭ টাকা লিটার। পামওয়েল ১১৭ টাকা। কিন্তু তা কিনতে হচ্ছে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকায়।

টিসিবির পণ্য পাবে কোটি পরিবার

এদিকে রমজান উপলক্ষে সারাদেশে ভর্তুকি মূল্যে পাঁচটি পণ্য বিক্রি করবে টিসিবি। ফ্যামিলি কার্ডধারী এক কোটি পরিবারের কাছে এই পাঁচটি পণ্য বিক্রি করা হবে। একজন কার্ডধারী ৬০ টাকা দরে এক কেজি চিনি, প্রতি কেজি ৭০ টাকা দরে সর্বোচ্চ ২ কেজি মসুর ডাল, ১১০ টাকা লিটার দরে সর্বোচ্চ ২ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল, ৫০ টাকা দরে এক কেজি ছোলা ও ১০০ টাকা দরে এক কেজি খেজুর কিনতে পারবেন। তবে খেজুর শুধুমাত্র ঢাকা সিটি করপোরেশনে বিক্রি হবে।

কী বলছে সরকার

রমজান ঘিরে পূর্ণ প্রস্তুতির কথা জানালেও বাজার নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে সরকারেরও। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের সংযমী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। বলেছেন, রমজানের জন্য আমাদের যে খাদ্যসামগ্রী দরকার, সেটা পুরোপুরি আমাদের হাতে রয়েছে।

রমজানে কেউ খাদ্যদ্রব্য মজুদের চেষ্টা করলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানিয়েছেন মন্ত্রী।

এদিকে পর্যাপ্ত প্রস্তুতির পরও রমজান ঘিরে দুশ্চিন্তা কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, সঠিকভাবে বাজার মনিটরিং করার পাশাপাশি অতি মুনাফার লোভ যতক্ষণ না কমবে ততদিন এভাবেই হয়তো চলবে। তবে তার আগে ক্রেতাকে একবারে সব কেনার প্রবণতাও বন্ধ করা উচিত।

বিইউ/জেএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর