শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

জীবন চালাতে খরচের খাতায় কাটছাঁট

বোরহান উদ্দিন
প্রকাশিত: ২৫ নভেম্বর ২০২২, ১২:৪১ পিএম

শেয়ার করুন:

জীবন চালাতে খরচের খাতায় কাটছাঁট

আগারগাঁওয়ের পাসপোর্ট অফিসের উল্টো পাশের ফুটপাতে পান-সিগারেটের বিক্রেতা গাইবান্ধার সেলিম উদ্দিন। দিনভর যা আয় হয় তা দিয়ে চলে সংসারের বাজার-সদাই। আর স্ত্রী অন্যের বাসায় কাজ করে যা পান তা ঘর ভাড়ায় শেষ হয়ে যায়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজনও যখন অনেকটা দিশেহারা, তখন নিম্নআয়ের সেলিম উদ্দিনের অবস্থা আরও নাজুক।

গত মঙ্গলবার দুপুরের দিকে প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় আতঙ্কভরা চেহারা নিয়ে তিনি বলেন, ‘ঘরে বাজার না নিলে রান্না হইবে না, উল্টো বউয়ের কথা শুনতে হইবে। বউ-পোলাপানের ধারে সম্মানও থাকবে না। বেচাবিক্রিও তেমন নাই। আগে পাঁচ প্যাকেট সিগারেট চললেও এখন তিন প্যাকেট শেষ হয় না। বুঝতেছি না সামনে কেমনে চলব।’


বিজ্ঞাপন


এত গেল ফুটপাতের দোকানি সেলিম উদ্দিনের কথা। একইদিন রাতে রায়সাহেব বাজারে মশলা কিনতে আসা ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেও মিলল বাজার নিয়ে অস্থিরতার কথা। 

জানালেন, নিজে সরকারি চাকরি করেন। এক ছেলে পুরান ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালের চিকিৎসক, এক ছেলে ইন্টার্ন করছেন সরকারি একটি হাসপাতালে। আরেকজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি প্রত্যাশী। সব মিলিয়ে ভালো থাকলেও এখন ব্যয়ের ক্ষেত্রে কিছুটা কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছেন।

ঢাকা মেইলকে ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘এখন আর বাজার করতে আসলে দাম জিজ্ঞেস করি না। জানি দাম শুনলেও লাভ নেই, যা বাড়ছে তা কমবে না। আরও বাড়বে। বাধ্য হয়ে পরিমাণে কম নিচ্ছি। সন্তানদের জন্যই তো সবকিছু। ওরা বড় হলেও বাবা হিসেবে এখনও কেনাকাটা আমিই করি। কিন্তু হিসেব মিলে না।’

করোনার মহামারির রেশ কাটতে না কাটতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সারাবিশ্বে অর্থনীতিতে টালমাটাল অবস্থা। বাংলাদেশের পরিস্থিতিও খুব একটা ভালো নয় বলছেন অর্থনীতিবিদরা। দুর্ভিক্ষ হওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করা হচ্ছে।

এদিকে ব্যাংকে ডলার সংকট, রিজার্ভ কমে যাওয়া, রফতানিও কমে গেছে। ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকে এলসি খুলতেও সমস্যার মধ্যে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। অর্থনীতির নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে নিত্যপণ্যের বাজারে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। ক্রমেই নানা অজুহাতে বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। 

যদিও সরকারের একাধিক সংস্থা বাজার নিয়ন্ত্রণ, মজুতদারদের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে জরিমানা করলেও এর খুব একটা প্রভাব পড়ছে না বাজারে। বরং কঠোর অভিযান শুরু হলেও সরকারের বেধে দেওয়া দামে পণ্য কেনা তো যায় না, বরং পণ্য সরিয়ে ফেলেন ব্যবসায়ীরা। তাই বাড়তি দাম মেটাতে গিয়ে ব্যয় সংকোচন নীতির দিকে হাঁটছেন বেশিরভাগ মানুষ।

তবে বাজার বিশ্লেষকরা এই ধরণের অভিযান জোরদার করার তাগিদ দিচ্ছেন। অন্যথায় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে। 

যদিও অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভোক্তা অধিকার আইনের জরিমানা বাড়াতে আইন সংশোধন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অধিদফতরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান।

ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘বিদ্যমান আইনে জরিমানা অপরাধ অনুযায়ী যথেষ্ট নয়। তাই আইনের সংশোধন প্রয়োজন। ওই আইনে যে জরিমানা ও শাস্তি রয়েছে তা দ্বিগুণ করা হচ্ছে।’

এদিকে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় বাজারে গিয়ে বাজেট মিলাতে পারছেন না ক্রেতারা। ফলে ব্যয়ের ক্ষেত্রে কাটছাঁট করতে একরকম বাধ্য হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আগে মেসে সপ্তাহে একদিন গরুর মাংস খাওয়া হত। দাম বাড়ায় গরু কেনা বন্ধ। মুরগিও কম কেনা হয়। মাছের মধ্যে কিছুটা কম দামেরগুলো খাওয়া হয়। এভাবে বাদ দিতে দিতে খাওয়াই ছেড়ে দিতে হবে।’

এদিকে বাজারের অস্থিরতার কারণে সরকারের ন্যায্যমূল্যে ‘ওএমএস’ কার্যক্রমের আওতায় চাল-আটা বিক্রির দোকানেও মানুষের লম্বা লাইন। কারণ বাজারের চেয়ে অনেক কমে এখানে চাল-আটা মিলছে।

আগে লোকজনের খুব চাপ না থাকলেও কিছুদিন ধরে নির্ধারিত সময়ের কয়েক ঘণ্টা থেকে নানা শ্রেণি-পেশার দোকানের সামনে দাঁড়াচ্ছেন। অবশ্য বাছাই করার সুযোগ না থাকায় জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি দিয়ে একই মানুষ ঘুরেফিরে এই দুই পণ্য কিনছেন বলে অভিযোগ আছে।

পুরান ঢাকার লক্ষীবাজারের একটি ওএমএসের দোকানের কর্মচারী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের যাচাই করার সুযোগ নেই। আইডি কার্ড নিয়ে আসে, চাল-আটা দিয়ে দেই। একজন বারবারও নেয়।’

এমন অবস্থায় বাজারে স্বস্তি ফেরাতে মনিটরিং জোরদারের তাগিদ দিয়ে কনজুমার অ্যাসোসিয়েন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আসলে তো আমরা কেউ ভালো নেই। যতটুকু না করলে নয় ততটুকু করছে মানুষ। কিন্তু অব্যবস্থাপনা ও  কতিপয় লোকের অতিলোভের কারণে বাজারে নৈরাজ্য চলছে। এভাবে তো বেশিদিন চলতে পারবে না। সরকারকে কঠোর হতে হবে।’

কারসাজি ঠেকাতে মাঠে নয় সংস্থা

এদিকে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, মূল্য কারসাজি  ঠেকাতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরসহ সরকারের নয়টি সংস্থা মাঠে নেমেছে। যার নেতৃত্ব আছেন বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পরিচালক (খাদ্যের বিশুদ্ধতা পরিবীক্ষণ ও বিচারিক কার্যক্রম) ড. সহদেব চন্দ্র সাহা। 

জানা গেছে, মুদি দোকানসহ নিত্যপণ্য বিক্রয়কারী পাইকারি ও খুচরা প্রতিষ্ঠান, কারখানা ও হোটেল-রেস্টুরেন্ট, শিশুখাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে যারা অনিয়ম করছে তাদের টার্গেট করে সমন্বিতভাবে কাজ শুরু করেছে।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের মনিটরিং অফিসার মো. ইমরান হোসেন মোল্লা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আপাতত প্রতি মাসে একবার এই নয়টি সরকারি সংস্থার সমন্বিত অভিযান পরিচালনা করা হবে। প্রয়োজন হলে একাধিকবার অভিযান চালানো হবে। এর বাইরেও প্রতিটি সংস্থা নিজ নিজ কার্যক্রম পরিচালনা করবে।’

বিইউ/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর