‘আগে বিভিন্ন নামি-দামী কোম্পানির সেলস ম্যানরা এসে দোকানে দাঁড়িয়ে থাকত অর্ডার কাটার জন্য। জোর করে অর্ডার কেটে দিয়ে যেত। ৩০ প্যাকেট মাল চাইলে জোর করে ৩৫ প্যাকেট ধরিয়ে দিত। কিন্তু এখন হয়ে গেছে উল্টো। আমাদেরকেই জোর করে মাল অর্ডার দিতে হয়। ৫০ প্যাকেট মাল চাইলে মাল দেয় ২০টা ৩০টা। ব্যবসা করুম ক্যামনে?’
কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর মুগদা এলাকার ঝিলপারের মুদি দোকানি মিঠু মিয়া। শুধু মিঠু মিয়াই নয়। এই এলাকার অধিকাংশ মুদি দোকানই এমন অভিযোগ করলেন। আজ কয়েক মাস ধরেই এমন অবস্থার কথা জানালেন তারা।
বিজ্ঞাপন
একই এলাকার আরেক দোকানি বলেন, ‘আজ কয়দিন ধরে চিনি সাপ্লাই নাই। কোনো কোম্পানিই চিনি দিচ্ছে না। কাস্টমারদের কাছে চিনি বিক্রি করতে পারছি না। আটা দিতে পারছি না। আজ এটা আছে তো কাল ওটা নাই। এখন ব্যবসা করাই কঠিন হয়ে গেছে।’
গত বেশ কয়েকদিন ধরেই রাজধানীর বাজারগুলোতে চিনির সংকট। অধিকাংশ দোকানেই পাওয়া যাচ্ছে না চিনি। দু-একটা দোকানে চিনি মিললেও দাম নিচ্ছে বাড়তি। চিনি ছাড়াও অনেক দোকানে পাওয়া যাচ্ছে না আটা, লবন, সয়াবিন তেলসহ বেশকিছু নিত্যপণ্য। একটাই কথা মাল আসে নাই, ‘সপ্লাই নাই’। আবার কোম্পানিগুলো বলছে গ্যাস সংকটের কারণে ঠিকমতো পণ্য উৎপাদন করা যাচ্ছে না। তাই ঠিকঠাক মতো সাপ্লাই দেওয়া যাচ্ছে না। যে কারণে শিল্প-কারখানার উৎপাদন ঠিক রাখতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যস সরবরাহ চাচ্ছেন তারা।
বিজ্ঞাপন
এদিকে গ্যাস সরবরাহ সংকটে চিনির উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি বলেন, অপ্রতুলতার কারণে ৬৬ শতাংশের বেশি উৎপাদন করতে পারছে না কারখানাগুলো। অনেক চিনি গুদামে পড়ে আছে। কারখানায় প্রক্রিয়া করতে পারলে বাজারে আসবে।
তিনি আরও বলেন, যারা গ্যাসের বিষয়টি দেখে তারা বলছে, পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটছে। বিদ্যুতের অবস্থা উন্নতি হবে, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আশা করি দু-এক দিনের মধ্যে গ্যাসের সাপ্লাই স্বাভাবিক হলে যে পরিমাণ চিনি দরকার, তা উৎপাদন সম্ভব হবে।
বৃহস্পতিবার (৩ নভেম্বর) দেশের বাজারে আবারও বোতলজাত সয়াবিন তেলের বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে ব্যবসায়ীরা। খুচরা পর্যায়ে প্রতি লিটারে ১৫ টাকা দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফেকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন।
এক বছরে দাম বাড়ল কয়েক দফায়। প্রতিবারও দাম বাড়ানোর পূর্ব মুহূর্তে একটা কৃত্রিম সংকট তৈরি হয় বাজারগুলোতে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে পণ্য আটকে রাখেন। এতে তৈরি হয় সংকট।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সচিব মো. নুরুল ইসলাম মোল্লা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ডলারের দাম বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও ডলারের বিপরীতে টাকার অস্বাভাবিক দরপতনের কারণে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। আবার গ্যাস সংকট। পরিশোধন করতে বেশি খরচ পড়ে যাচ্ছে। সব বিষয়ের কারণে আমদের অ্যাসোসিয়েশনভুক্ত সদস্যরা বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন।
অপরদিকে বাজারে নানা পণ্যের দাম বাড়ার হিড়িকের সঙ্গে কমেছে মুদি ব্যবসায়ীদের লাভের পরিমাণ। পণ্যের ক্রয় মূল্য বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই নতুন করে ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে হয়েছে। আবার যাদের পক্ষে নতুন বিনিয়োগ সম্ভব হয়নি, তারা ব্যবসা করছে টানাপোড়েনের সঙ্গে। মুদি ব্যবসায়ীদের ভাষ্যমতে, বর্তমানে প্রতি পাঁচ লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি করলে তাদের লাভ হয় ২০ টাকা। আর এর পেছনে বিনিয়োগ করতে হয় ৮৬০ টাকা। দেড় বছর আগেও ৫ লিটার সয়াবিন তেলে লাভ হতো ৫০ টাকা। তখন বিনিয়োগের পরিমাণও ছিল কম।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের মুদি ব্যবসায়ী ফরহাদ হোসেন জানান, বর্তমানে সরাবিন তেল ৫ লিটারের বোতল দোকানির কেনা ৮৬০ টাকা। আর বিক্রি ৮৮০ টাকা। ফরহাদ বলেন, জিনিসের দাম বেড়েছে, আমাদের বিনিয়োগ বেড়েছে, কিন্তু লাভ বাড়েনি বরং কমেছে।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এই বাড়তি দামের কারণে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে তাকে। ফরহাদ বলেন, ‘দোকানে যে ইনভেস্ট ছিল, সে টাকার মালামালে সব সময় দোকান ভরা থাকত। এখন দাম বাড়ার কারণে মালামাল দোকানে যেন অর্ধেক কমে গেছে। সব মালামাল রাখতে এবং দোকান ভরা রাখতে আবার ইনভেস্ট করেছি। বারবার তো সম্ভব না। খুবই সমস্যা হয়ে যাচ্ছে।’
টিএই/এএস