শুক্রবার, ৩ মে, ২০২৪, ঢাকা

আলোচনায় ২০২৩ সালের মন্দা, কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ?

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৭ অক্টোবর ২০২২, ০৯:৪৯ পিএম

শেয়ার করুন:

আলোচনায় ২০২৩ সালের মন্দা, কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ?
ফাইল ছবি

আগামী ২০২৩ সাল বিশ্ববাসীর জন্য সংকটের বছর হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আবহাওয়া পরিবর্তন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধসহ বৈশ্বিক নানা কারণে আগামী বছরটি মন্দার হবে বলে আভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ইতোমধ্যে সেই মন্দা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে বাংলাদেশেও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিক অনুষ্ঠানে মন্দার ব্যাপারে আগাম সতর্ক করেছেন। এছাড়া সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের আলোচনায়ও উঠে আসছে বিষয়টি। সম্ভাব্য এই সংকট বাংলাদেশে কতটা প্রভাব ফেলবে, তা মোকাবেলায় কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে সেটা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে সরকারের নীতি-নির্ধারণী মহলে।

বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি 'বিশ্বে কি মন্দা আসন্ন' শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব অর্থনীতির তিন মূল চালিকাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপের অর্থনীতি দ্রুত গতি হারাচ্ছে। ফলে আগামী বছরে সামান্য আঘাতেও মন্দা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। সেই প্রতিবেদনের পরই মূলত মন্দার বিষয়টি আলোচনায় আসে।


বিজ্ঞাপন


গত মঙ্গলবার (৪ অক্টোবর) দুর্গোৎসব উপলক্ষে এক মতবিনিময় সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম মন্দার বিষয়টি জোরালোভাবে আলোচনা করেন। সেখানে তিনি জানান, মহামারি করোনার পর ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে ২০২৩ সালে বিশ্বে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। এজন্য দেশবাসীকে সতর্ক থাকার পাশাপাশি মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান জানান সরকারপ্রধান।

শেখ হাসিনা বলেন, করোনার পর যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অনেক দেশে সমস্যা দেখা দিয়েছে। ২০২৩ সালে দুর্ভিক্ষের শঙ্কার কথা বললে জাতিসংঘে বিশ্বের অনেক দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান আমার সঙ্গে একমত হয়েছেন। সেজন্য দেশবাসীকে সতর্ক থাকার পাশাপাশি এক ইঞ্চি জমিও যেন পড়ে না থাকে সে বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

আরও পড়ুন: ২০২৩ হবে মহাসংকটের বছর: প্রধানমন্ত্রী


বিজ্ঞাপন


এরপর বৃহস্পতিবার (৬ অক্টোবর) বিকেলে গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত বলেন সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী একটা আশঙ্কা, ২০২৩ সাল একটা মহাসংকটের বছর হবে। সেজন্য আগে থেকেই আমাদের প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টা বেশি বিবেচনা করা দরকার। যার যার জায়গা আছে, চাষ শুরু করে দেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার জন্য যেটুকু বিদ্যুৎ দরকার সেটুকু দিতে পারব। জনগণের কষ্ট যেন না হয়, সে দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিচ্ছি।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘সারা বিশ্বের মানুষ যখন কষ্টে থাকে, তখন কি নিজেরা শান্তিতে থাকা যায়? উন্নত দেশের মানুষরা কষ্ট পাচ্ছে। আমার দেশের মানুষের যেন কষ্ট না হয়, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছি। কৃষি খাতে বাজেট ছাড়াও আলাদা বাজেট করেছি। আমার দেশের মানুষ যেন ভালো থাকে।’

monda2

সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী জানান, আগামী বছর বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। এজন্য তিনি সংশ্লিষ্টদের জন্য বৈঠক করেছেন এবং পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ রাখার ব্যবস্থা করেছেন।

কতটা প্রভাব পড়বে, কী প্রস্তুতি বাংলাদেশের?

শুক্রবার (৭ অক্টোবর) বিকেলে সিলেটে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন জানান, আগামী বছর (২০২৩ সাল) বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার যে সতর্ক বার্তা জাতিসংঘ দিয়েছে তাতে বাংলাদেশে খুব একটা প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন তিনি। তাঁর মতে এই মন্দার কারণে বাংলাদেশের খুব একটা ক্ষতি হবে না।

আবদুল মোমেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন বিশিষ্টজনের সাথে আলাপ করেছেন। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত দেখে তারা বলেছেন, আগামী বছর সারা পৃথিবীর জন্য অর্থনৈতিকভাবে মন্দা হবে। তবে তাতে বাংলাদেশের খুব ক্ষতি হবে না।

আরও পড়ুন: ২০২৩ সালে দুর্ভিক্ষের শঙ্কা, সতর্ক থাকার পরামর্শ প্রধানমন্ত্রীর

মন্ত্রী বলেন, সংকট মোকাবেলায় দরকার খাদ্য। সরকার তা নিশ্চিতের চেষ্টা করছে। খাদ্যের ব্যবস্থা করতে পারলে বাকি সবকিছুর ব্যবস্থা করা যাবে।

এদিকে পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান জার্মানভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সম্ভাব্য মন্দা ইস্যুতে বিস্তারিত বলেছেন। মন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন সচেতন মহল, বিশেষ করে অর্থনীতিবিদরা একটা মন্দার আশঙ্কা করছেন৷ মন্দা যখন উন্নত অর্থনীতিতে হবে, তখন আমরা যারা তাদের অধঃস্তন অর্থনীতি বলতে পারেন, কারণ আমরাও তাদের সঙ্গে বিশ্ববাজারের অংশ৷ আমরাও বিশ্ববাজারে বিক্রি করি, কিনি ইত্যাদি, ইত্যাদি৷ সুতরাং ওখানে মন্দা হলে আমাদের এখানেও হয়ে যাবে৷ এটা এড়ানোর কোনো পথ নেই৷

এম মান্নান বলেন, আমরা কী ব্যবস্থা নিতে পারি? যেহেতু এটা বিশ্বজনীন সমস্যা, বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতি যেমন চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জার্মানি তারা ঘরে ফেরার জন্য যেসব ব্যবস্থা নেবে এবং তারা মন্দা থেকে বের হওয়ার যদি কোনো পথ পায় আমরাও পাবো বলে আশা করি৷ বিশ্ব অর্থনীতিকে প্রভাবিত করার মতো অবস্থা আমাদের নেই৷ আমরা যদি কৃষিতে উৎপাদন ঠিক রাখতে পারি, স্থানীয় বাজারে যদি চালের সরবরাহ ঠিক রাখতে পারি তাহলে অনেকটা প্রশমিত হবে৷

মন্দার সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন,মানুষের কল্যাণের জন্য আমাদের যে উন্নয়ন প্রকল্প সেগুলো বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে৷ ঋণের বাজারও সংকুচিত হবে৷ বিশ্বব্যাংক বা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংককে যারা তহবিল দেয় ওই বড় অর্থনীতিগুলো তারা মন্দায় পড়ে গেলে টাইট হয়ে যাবে৷ তারা টাইট হয়ে গেলে এসব সংস্থার ঋণ দেওয়ার শক্তি কমে যাবে৷ তখন আমরা হাত বাড়ালেই ঋণ পাবো না৷ যদিও এখানে কথা আছে, ঋণ দিলেই যে আমরা নেব এমন কোনো কথা নেই৷

আরও পড়ুন: ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মন্দার শঙ্কা, সতর্ক করল বিশ্বব্যাংক

উত্তরণের উপায় সম্পর্কে জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার মধ্যে পড়লে আমাদের দুইটা কৌশল নিতে হবে৷ একটা হলো অভ্যন্তরীণ বাজার অর্থাৎ কৃষি, কায়িক পরিশ্রম যারা করে অনানুষ্ঠানিকখাতে তাদের সহায়তা দিয়ে চাঙ্গা রাখতে হবে৷ সারা বিশ্বের তাপ আমাদের গায়ে লাগবেই৷ সেটা আমাদের কৌশলের সঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে৷ আরেকটা হলো ব্যয় সাশ্রয়ী হতে হবে৷ অভিলাসী পরিকল্পনা কাটছাঁট করতে হবে এবং কোমরে বেল্ট বাঁধতে হবে৷ এইসবই আমাদের করণীয় হতে পারে৷

monda3

বাংলাদেশে কোন খাতে প্রভাব পড়তে পারে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, মন্দা হলে আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়তে পারে এক্সপোর্ট খাতে৷ আমরা তো মাঝারি যেসব সামগ্রী যেমন কাপড়, সবজি, মাছ এগুলো আমরা রফতানি করি৷ পশ্চিমা দেশগুলোতে মন্দা হলে এসবের ডিমান্ড কমে যাবে৷ ডিমান্ড কমে গেলে আমরা কোথায় পাঠাব? সুতরাং আমাদের এক্সপোর্টের ওপর একটা আঘাত আসবে৷ সেটা হলো আমাদের প্রাথমিক এবং প্রধান আঘাত৷

আরেকটা হলো, পশ্চিমা মন্দা মধ্যপ্রাচ্যে আসবেই৷ ফলে সেখানে আমাদের যেসব শ্রমিক শারীরিক পরিশ্রম করে কাজ করে সেসব শ্রমিকের ডিমান্ডও কমে যাবে৷ ফলে তাদের আয়ও কমে যাবে৷ তারা দেশে কম টাকা পাঠাবে৷ ফলে এখানেও একটা আঘাত আসবে৷ এসব কারণে আমাদের সরকারি ব্যয় অনেক কমাতে হবে৷ বেসরকারি খাতেও সংশ্লিষ্টরা ব্যয় পুনর্বিন্যাস করবেন৷ যাতে কম জরুরি ব্যয় পরে করা যায়৷

পরিকল্পনা মন্ত্রী বলেন, মন্দা তো আর চিরস্থায়ী হবে না, মন্দারও একটা সময় আছে৷ কিছুদিন পর মন্দাও উঠে দাঁড়াবে৷ তখন আমরাও উঠে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবো৷ সারা বিশ্বের অর্থনীতি এখন একটা চেইনের মধ্যে আছে৷ আগের মতো বিছিন্ন নই আমরা৷ এর ভালো দিক হলো, সারা বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও সামনের দিকে এগোতে পারি৷ আর মন্দ দিক হলো, ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য আমরা দায়ী নই, কোভিডের জন্য আমরা দায়ী নই, পশ্চিমাদের ভূরাজনৈতিক কৌশলের কারণে আমরা দায়ী নই, অথচ আমরা এর শিকার৷ এর থেকে বের হওয়ার পথ আমাদের সীমিত৷ ফলে আমি যদি আমার কোমরে বেল্ট বাঁধি, কেউ তো মানা করতে পারবে না৷ আমি যদি তিন তরকারি দিয়ে ভাত না খেয়ে দুই তরকারি দিয়ে ভাত খাই তাও তো সাশ্রয় হবে৷ কিছু কিছু নির্মাণ কাজ যেগুলো দুই বছর পরে করলেও সমস্যা নেই সেগুলো তখন করব না৷ খুব জরুরি যেগুলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি এগুলো ধরে রেখে বাকিগুলোতে কাটছাঁট করি তাহলে আমার মনে হয় আমরাও পার হতে পারবো৷ কিছু বাধা তো আসবেই৷

জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর