শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

অর্থনীতিতে আরও চাপ বাড়ার শঙ্কা

বোরহান উদ্দিন
প্রকাশিত: ০৪ অক্টোবর ২০২২, ০৮:৫২ এএম

শেয়ার করুন:

অর্থনীতিতে আরও চাপ বাড়ার শঙ্কা

করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করেছে। মাঝে ডলারের দাম বৃদ্ধির পর এখন কিছুটা কমের দিকে থাকলেও দেশের অর্থনীতিতে নতুন করে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে চলতি মাসে প্রবাসী আয়ে ভাটার টান ও রফতানি আয়ের কমে যাওয়া। বৈদেশিক মুদ্রার এই দুই বড় উৎসে আয় কমায় ব্যবসায়ীসহ সবার মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে রিজার্ভও ক্রমেই কমে আসছে। এমনটা চলতে থাকলে সামনে অর্থনীতির ওপর চাপ আরও বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে রফতানি আয়ের অন্যতম খাত পোশাক শিল্পের মালিকরা বলছেন, নিরবিচ্ছিন্নভাবে গ্যাস ও বিদ্যুৎ পাওয়া না গেলে আন্তর্জাতিক বাজার হারানোর সম্ভাবনা আছে। তাই আমদানি করা যায় এমন পণ্যে প্রয়োজনে গ্যাস কমিয়ে দেওয়া, বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস দেওয়া বন্ধ করা ও বাসা-বাড়ির অবৈধ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।


বিজ্ঞাপন


গ্যাস সংকটের কারণে ঠিকভাবে উৎপাদন করা যায়নি- ঢাকা মেইলকে এমনটাই জানিয়েছেন নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, আমরা গত একমাস ধরেই বলে আসছি- অর্থনীতিতে ধস নামবে। তাই পোশাকখাতের রফতানি আয় কমা পূর্ব অনুমিত ছিল। এর কারণ বিদেশি ক্রেতারা তাদের অর্ডার বাতিল করেছে। আর আমাদের নিটওয়্যার সেক্টরে যেটা বড় সমস্যা হয়েছে, তা হলো গ্যাস সংকট। গ্যাসের স্বল্পতার কারণে সংকটটা তৈরি হয়েছে। বায়াররা বেশি অর্ডার বাতিল করেছে। এমন অবস্থা করোনার পর থেকে হয়নি। আমাদের হাতে যে অর্ডার আছে, সেটাও গ্যাস সংকটের জন্য সময়মতো দিতে পারিনি। এ কারণে আপাতত রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের সূচক বাড়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে রিজার্ভ আরও কমতে পারে। সবমিলিয়ে চাপের মধ্যে পড়বে দেশের অর্থনীতি।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে পাওয়া সর্বশেষ (৩ অক্টোবর) তথ্যমতে, সেপ্টেম্বরে রফতানি ৬ শতাংশ এবং প্রবাসী আয় প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশ কমেছে। সেই সঙ্গে সাত মাস পর সবচেয়ে কম রেমিট্যান্স এসেছে সদ্য শেষ হওয়া সেপ্টেম্বরে। এই মাসে ১৫৩ কোটি ৯৫ লাখ (১ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন) ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে ১৪৯ কোটি ৪৪ লাখ ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।

এদিকে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই (জুলাই-আগস্ট) দুই বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে। সেপ্টেম্বরে তা এক ধাক্কায় দেড় বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।

অন্যদিকে দীর্ঘ ১৩ মাস পর রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি কমেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে আগের বছরের জুলাইয়ের চেয়ে রফতানি আয় কমেছিল ৬ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। এরপর থেকে এক বছরের বেশি সময় রফতানি আয়ে বড় প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল। সবমিলিয়ে ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। যেখানে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে এসে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।


বিজ্ঞাপন


ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর মাসে রফতানি আয়ে যে ধাক্কা লেগেছে, তা মূলত তৈরি পোশাক রফতানি কমার কারণে হয়েছে। গত মাসে ৩১৬ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে, যা গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ কম। এমনকি গত মাসে ওভেন ও নিট উভয় ধরনের পোশাকে রফতানিও হ্রাস পেয়েছে।

অন্যদিকে রিজার্ভও কমছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে। গত ৮ সেপ্টেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জুলাই-আগস্ট মেয়াদের ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার আমদানির বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৩৭ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ফলে ২৬ মাস (দুই বছর দুই মাস) পর রিজার্ভ ৩৭ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নামে। তবে রিজার্ভ আরও কম বলেও আভাস মিলছে।

এতে পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, সামগ্রিকভাবে শিল্পের জন্য একটি বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে সাভার ও গাজীপুরের শিল্প এলাকায় তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে উৎপাদনে।

অন্যদিকে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোয় মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। যা নিয়ন্ত্রণে দেশগুলো সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করে বাজারে টাকার প্রবাহ কমাচ্ছে। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। ভোক্তারা পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। পাশাপাশি একাধিক খাতে উৎপাদন খরচ বাড়ায় পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এসব কারণে রফতানি আয়ও কমছে।

যদিও পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ইপিবির পক্ষ থেকে রফতানি আয় বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি যেসব দেশ বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো হচ্ছে। সেই সঙ্গে অন্যান্য দেশে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।

তবে সামনের দিকে উৎপাদন অব্যাহত রাখতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস দেওয়ার দাবি করেছেন নিটওয়্যার খাতের ব্যবসায়ী নেতা মোহাম্মদ হাতেম। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘সময়মতো পণ্য পাঠাতে না পারায় আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এক মাসের পণ্য অন্য মাসে পাঠালে হয়তো মূল্য ছাড় দিতে হবে, না হয় বিমানে পাঠাতে হবে। এতে আমার খরচ অনেক বেড়ে যাবে। এতে বিক্রি করে যা পাবো তার অর্ধেক বিমান ভাড়ায় যাবে। তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হবে। তাই বিদ্যুতে গ্যাস বন্ধ করা, সারসহ যেসব পণ্য অন্য দেশ থেকে আমদানি করা যায় সেসব জায়গায় গ্যাস দেওয়া বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি বাসা-বাড়ির অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে। না হলে সামনে আরও খারাপ হবে পরিস্থিতি।’

সার্বিক বিষয়ে কথা হলে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর ঢাকা মেইলকে বলেন, অর্থনীতিকে সামাল দেওয়া দুই সূচক কমে যাওয়া অবশ্যই বড় দুশ্চিন্তার কারণ। এই দুই সূচক না বাড়লে রিজার্ভ আরও কমবে। আর রিজার্ভ যা বলা হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে তার চেয়েও কম রয়েছে। ফলে সামনে অর্থনীতিতে চাপ আরও বাড়ার সম্ভাবনা আছে।

বিইউ/আইএইচ/এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর