বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

সালতামামি-২০২৫

জ্বালানি সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতার চাপ ছিল দেশের শিল্প–অর্থনীতি

মহিউদ্দিন রাব্বানি
প্রকাশিত: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:১০ পিএম

শেয়ার করুন:

জ্বালানি সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতার চাপ ছিল দেশের শিল্প–অর্থনীতি

২০২৫ সালটি বাংলাদেশের শিল্প ও সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য ছিল গভীর অনিশ্চয়তা ও কাঠামোগত চ্যালেঞ্জে ভরা একটি বছর। জ্বালানি সরবরাহের দীর্ঘস্থায়ী সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিনিয়োগ পরিবেশের দুর্বলতার কারণে শিল্পকারখানার উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে, রফতানি প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশার তুলনায় কমেছে এবং অর্থনীতিতে স্থবিরতার লক্ষণ আরও স্পষ্ট হয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী মহলের অভিন্ন মত—এই সংকটের মূলে রয়েছে নীতিগত সিদ্ধান্তহীনতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা। টেকসই সমাধানের জন্য জ্বালানি খাতে কঠিন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের পাশাপাশি দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য ও কার্যকর নির্বাচন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।


বিজ্ঞাপন


জ্বালানি সরবরাহে ঘাটতি, শিল্প উৎপাদনে স্থবিরতা:
২০২৫ সালে শিল্পখাতে উৎপাদন ব্যাঘাতের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে গ্যাস সংকট। সংশ্লিষ্ট খাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ না থাকায় অনেক কারখানায় উৎপাদন সক্ষমতার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অব্যবহৃত থেকে গেছে। যার কারণে উৎপাদন সময় কমানো, অতিরিক্ত জেনারেটর ব্যবহার এবং বিকল্প জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে, যা উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়েছে।

বিশেষ করে তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, সিরামিক, স্টিল, কেমিক্যাল ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে জ্বালানি সংকটের প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট। শিল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, জ্বালানি সরবরাহের অনিশ্চয়তা দীর্ঘমেয়াদি উৎপাদন পরিকল্পনাকে বাধাগ্রস্ত করেছে।

রফতানি খাতে চাপ, বৈদেশিক আয়ে অনিশ্চয়তা:
উৎপাদন ব্যাঘাতের সরাসরি প্রভাব পড়েছে রপ্তানি খাতে। ২০২৫ সালে রপ্তানি আয় প্রত্যাশিত গতিতে বাড়েনি। সময়মতো পণ্য সরবরাহে ব্যর্থতা, লিড টাইম বেড়ে যাওয়া এবং উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান দুর্বল হয়েছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

অর্থনীতিবিদদের মতে, রপ্তানি আয়ের এই চাপ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবস্থাপনাকে আরও কঠিন করে তুলেছে এবং আমদানি ব্যয় ও মুদ্রাবাজারের স্থিতিশীলতার ওপর প্রভাব ফেলেছে।


বিজ্ঞাপন


রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিনিয়োগ আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত:
২০২৫ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থনীতির জন্য আরেকটি বড় নেতিবাচক উপাদান হিসেবে কাজ করেছে। রাজনৈতিক কর্মসূচি, অনিশ্চিত পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ নীতি সম্পর্কে অস্পষ্টতার কারণে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগ সিদ্ধান্তে সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন।

ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর ভাষ্য অনুযায়ী, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া বড় আকারের শিল্প বিনিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন বা কর্মসংস্থান সম্প্রসারণ সম্ভব নয়। ফলে শিল্প খাতে নতুন বিনিয়োগের গতি মন্থর হয়ে পড়ে।

জ্বালানি সংকট: অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়
অর্থনীতিবিদরা বারবার উল্লেখ করেছেন, জ্বালানি সংকট কেবল প্রযুক্তিগত বা অর্থনৈতিক সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা নয়; এটি মূলত একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। এলএনজি আমদানি নীতি, গ্যাস–বিদ্যুৎ খাতে সংস্কার, ভর্তুকি ব্যবস্থাপনা এবং দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সময়োপযোগী ও সাহসী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। তাদের মতে, অস্থায়ী সমাধান নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও নীতিগত সংস্কার ছাড়া শিল্পখাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।

গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া আস্থা ফেরানো কঠিন:
২০২৫ সালের অভিজ্ঞতা থেকে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী মহলের একটি স্পষ্ট বার্তা উঠে এসেছে—রাজনৈতিক অস্থিরতা মোকাবেলায় দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক ও কার্যকর নির্বাচন আয়োজন অপরিহার্য। জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত সরকার ছাড়া জ্বালানি খাতে কঠিন সিদ্ধান্ত, বিনিয়োগবান্ধব সংস্কার এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা কঠিন হবে।

উপসংহার: শিক্ষা ও চ্যালেঞ্জ
বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৬ সালের অর্থনৈতিক গতি অনেকটাই নির্ভর করবে ২০২৫ সালের অভিজ্ঞতা থেকে সরকার কতটা কার্যকর শিক্ষা নিতে পারে তার ওপর। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং জ্বালানি খাতে কাঠামোগত সংস্কারই পারে শিল্প ও অর্থনীতিকে টেকসই পথে ফিরিয়ে আনতে।

এমআর/ক.ম 

 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর