বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

সালতামমি-২০২৫

মূল্যস্ফীতি, ডলার চাপ ও বিনিয়োগ স্থবিরতার বছর

মহিউদ্দিন রাব্বানি
প্রকাশিত: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:০৭ পিএম

শেয়ার করুন:

মূল্যস্ফীতি, ডলার চাপ ও বিনিয়োগ স্থবিরতার বছর

২০২৫ সাল বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ছিল টানা চাপের একটি বছর। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, অভ্যন্তরীণ নীতিগত সীমাবদ্ধতা এবং আর্থিক খাতে সুশাসনের ঘাটতি—সব মিলিয়ে পুরো বছরজুড়েই অর্থনীতি ছিল অস্থিরতার মধ্যে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ব্যয় বেড়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, আবার নীতিনির্ধারকদের জন্য এই বছরটি হয়ে উঠেছে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়।

উর্ধমুখী মূল্যস্ফীতিতে নড়বড়ে জীবনযাপন:
২০২৫ সালে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে দৃশ্যমান ও আলোচিত সংকট ছিল মূল্যস্ফীতি। খাদ্য, জ্বালানি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়তে থাকায় মানুষের প্রকৃত আয় কমে যায়। শহরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও বাজারদরের চাপ স্পষ্টভাবে অনুভূত হয়। সরকার ভর্তুকি, আমদানি শুল্ক কমানো, টিসিবি ও ওএমএস কার্যক্রম বাড়ালেও বাজারে তাৎক্ষণিক স্বস্তি আসেনি। তবে বছরের শেষ প্রান্তিকে কৃষিপণ্যের সরবরাহ বাড়ায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে।


বিজ্ঞাপন


ডলার সংকটে বাণিজ্য ও উৎপাদনে চাপ:
ডলার সংকট ২০২৫ সালেও আমদানি ও শিল্পখাতকে চাপে রেখেছে। কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে বিলম্ব হওয়ায় অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদন ব্যাহত হয়। এলসি খোলায় কড়াকড়ি এবং ডলারের বিনিময় হার অস্থির থাকায় ব্যবসায়ীদের খরচ বেড়েছে। সরকার রেমিট্যান্স বাড়াতে নগদ প্রণোদনা অব্যাহত রাখলেও হুন্ডির কারণে বৈধ চ্যানেলে প্রত্যাশিত প্রবাহ নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে।

রপ্তানিতে পোশাকনির্ভরতা, ঝুঁকি কাটেনি:
২০২৫ সালেও তৈরি পোশাক খাত রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে ভূমিকা রাখে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অর্ডার কিছুটা স্থিতিশীল হলেও মূল্যচাপে লাভ কমেছে। পোশাকের বাইরে ওষুধ, চামড়া, কৃষিপণ্য ও আইটি সেবায় রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টা চললেও কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হয়নি। ফলে রপ্তানি কাঠামো বহুমুখীকরণের চ্যালেঞ্জ আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকটে ছিলে শিল্পখাত:
২০২৫ সালে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ঘাটতি শিল্পখাতে বড় বাধা হিসেবে দেখা দেয়। এলএনজি আমদানিতে ব্যয় বৃদ্ধি ও সরবরাহ অনিশ্চয়তার কারণে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান উৎপাদন সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করতে পারেনি। এর প্রভাব পড়ে কর্মসংস্থান ও রপ্তানি উভয় ক্ষেত্রেই।

ব্যাংকিং খাত- খেলাপি ঋণের ভার:
ব্যাংকিং খাতে ২০২৫ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছায়। পুনঃতফসিল, ছাড় ও নীতিগত শৈথিল্য ঋণ আদায়ে কাঙ্ক্ষিত ফল দেয়নি। আমানতকারীদের আস্থা কিছুটা দুর্বল হয় এবং নতুন বিনিয়োগে ব্যাংকগুলোর সক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাস্তবভিত্তিক করার চেষ্টা করলেও অর্থনীতিতে এর প্রভাব ছিল ধীর।


বিজ্ঞাপন


রাজস্ব আদায়ে চ্যালেঞ্জ, বাজেট ব্যবস্থাপনায় কৃচ্ছ্রতা:
২০২৫ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ কঠিন হয়ে পড়ে। করজাল সম্প্রসারণ ও অনলাইন রিটার্ন ব্যবস্থায় অগ্রগতি থাকলেও কর ফাঁকি ও কর সংস্কৃতির দুর্বলতা বড় বাধা হয়ে থাকে। ফলে সরকার উন্নয়ন ব্যয়ে সংযমী নীতি গ্রহণ করে। অবকাঠামো প্রকল্পে ব্যয় নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু রেখে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
 
বিনিয়োগে আস্থার সংকট, কর্মসংস্থানে প্রভাব:
রাজনৈতিক ও নীতিগত অনিশ্চয়তা, ডলার সংকট এবং ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতার কারণে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাশিত হারে বাড়েনি। নতুন শিল্প ও ব্যবসা না বাড়ায় কর্মসংস্থানের গতি ছিল ধীর। বিশেষ করে তরুণদের জন্য মানসম্মত কর্মসংস্থান সৃষ্টি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।

সামাজিক বাস্তবতা ও অর্থনৈতিক চাপ:
অর্থনৈতিক চাপের সরাসরি প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের জীবনে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি সঞ্চয় ভেঙে ব্যয় মেটাতে বাধ্য হয়, নিম্নআয়ের মানুষ পড়েন আরও অনিশ্চয়তায়। সামাজিক বৈষম্য কিছু ক্ষেত্রে বাড়ার আশঙ্কাও উঠে আসে।

সংকটের মধ্যেই সংস্কারের তাগিদ:
অর্থনীতিবিদদের মতে, ২০২৫ সাল স্পষ্ট করে দিয়েছে যে কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। ব্যাংকিং খাতে সুশাসন, করব্যবস্থার সংস্কার, রপ্তানি বহুমুখীকরণ এবং জ্বালানি খাতে দক্ষতা বাড়ানোই সামনে পথ দেখাতে পারে।

সংশ্লিষ্টতা বলছেন, ২০২৫ সাল বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ছিল বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার বছর। সংকট, সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতার মধ্য দিয়েই আগামী দিনের জন্য নতুন সিদ্ধান্ত ও নীতিগত পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হয়েছে। যথাযথ সংস্কার ও স্থিতিশীল নীতি বাস্তবায়ন করা গেলে এই কঠিন সময়ই ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক ঘুরে দাঁড়ানোর ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে।
 
এমআর/

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর