ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনায় নীতি সংক্রান্ত অসঙ্গতি ও দুর্নীতি দৃশ্যমান। নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতকে প্রাধান্য না দেওয়া, জীবাশ্ম জ্বালানিতে অতিরিক্ত নির্ভরতা, এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতার অভাব দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের পথে বড় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। এ অবস্থা বজায় থাকলে ২০৫০ সালের নবায়নযোগ্য জ্বালানি লক্ষ্য পূরণ করা কঠিন হয়ে যাবে।
বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে টিআইবি আয়োজিত ‘বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। যৌথভাবে গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন এনার্জি গভর্ন্যান্সের অ্যাসিস্ট্যান্ট কো-অর্ডিনেটর আশনা ইসলাম এবং কো-অর্ডিনেটর নেওয়াজুল মওলা।
বিজ্ঞাপন
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্প্রসারণ এবং কার্বন নিঃসরণের ক্রমবৃদ্ধি প্যারিস চুক্তি, আইএনডিসি এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) পূরণের বিপরীত পদক্ষেপ। এতে আমদানি করা জ্বালানি ও বিদ্যুতের ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। চলমান প্রকল্পগুলোর ধীর অগ্রগতি ২০৫০ সালের মধ্যে ১০০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সহায়ক নয়।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশে বর্তমানে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা প্রায় ৯৫ শতাংশ, বিপরীতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর নির্ভরতা ৪ শতাংশের বেশি নয়। অর্থাৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত সব সময় অবহেলিত হয়েছে।
টিআইবি নির্বাহী পরিচালক বলেন, জ্বালানি খাতের নীতি, কৌশল ও পরিকল্পনায় অসংগতি এবং অস্পষ্টতা বিদ্যমান। ক্লিন এনার্জির ওপর অগ্রাধিকার প্রদর্শন করা হলেও তা পরীক্ষিত নয়। ভূমি অধিগ্রহণ ও অন্যান্য দুর্নীতির মাধ্যমে নবায়নযোগ্য প্রকল্পেও দুর্নীতি হয়েছে। মূলত নীতিগতভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত প্রাধান্য পায়নি, ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ ক্রমাগত কমে যাচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্থাপিত সক্ষমতা ২৮,৬১৬ মেগাওয়াট, যার মধ্যে নবায়নযোগ্য অংশের সক্ষমতা মাত্র ১,৩১৪ মেগাওয়াট। ২০১০-২০২৩ সময়কালে বিদ্যুৎ খাতে প্রায় ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ হলেও এর ৯৬.৭ শতাংশ জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক খাতে এবং মাত্র ৩.৩ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে ব্যবহৃত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ১২২১.৪ মেগাওয়াট সক্ষমতাসম্পন্ন মাত্র ১৭টি গ্রিড সংযুক্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, জ্বালানি নীতি ও পরিকল্পনাগুলোতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে পর্যাপ্ত অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে না। লক্ষ্য নির্ধারণে অসংগতি ও সমন্বয়হীনতা এ খাতের সময়মতো লক্ষ্য অর্জনে বড় বাধা। বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা মূলত জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে, ফলে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার অনুযায়ী লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়নি।
গবেষণায় দেখা গেছে, উন্নয়ন অংশীদারদের বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট স্বার্থের কারণে সরকারের নীতিনির্ধারণ ও পরিকল্পনায় প্রভাব বিস্তারের ঝুঁকি রয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে প্রণোদনার ঘাটতি, বেসরকারিকরণ নীতি এবং প্রকল্প অনুমোদন ও দরপত্র প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাবের ফলে খাতটি প্রভাবশালী কর্পোরেট উদ্যোক্তাদের নিয়ন্ত্রণে পড়েছে। বিদেশি প্রযুক্তির ওপর উচ্চ নির্ভরতা, সরকারী বিনিয়োগের ঘাটতি এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এই খাতের প্রসার ও রূপান্তরে বড় চ্যালেঞ্জ।
এএইচ/ক.ম

