- সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি খাদ্যপণ্যের দাম স্থিতিশীলতার কারণে এক অঙ্কে নেমেছে
- আমানত বৃদ্ধির হার শক্তিশালী, তবে ঋণ সম্প্রসারণ স্থবির
- রাজস্ব সংগ্রহ লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে, যদিও বছরের ভিত্তিতে বৃদ্ধি দেখা গেছে
- রফতানি অস্থিতিশীল হলেও সামান্য পুনরুদ্ধার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে
চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতার লক্ষণ স্পষ্ট হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ সরবরাহ শৃঙ্খলের উন্নতি এবং আমদানিকৃত পণ্যের ওপর চাপ কমে আসায় মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। অক্টোবর ২০২৫- এ সার্বিক মূল্যস্ফীতি নেমে এসেছে ৮.১৭ শতাংশে, যা এক বছর আগে অক্টোবর ২০২৪-এ ছিল ১০.৮৭ শতাংশ। খাদ্য পণ্যের দামে দ্রুত পতন এই নিম্নমুখী প্রবণতার প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
বিজ্ঞাপন
খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি এক বছরের ব্যবধানে ১২.৬৬ শতাংশ থেকে কমে ৭.০৮ শতাংশে নেমে এসেছে। অন্যদিকে, অ-খাদ্য মূল্যস্ফীতি সামান্য বেড়ে ৯.১৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যেখানে আবাসন, পরিবহন ও স্বাস্থ্যসেবা খাতে ব্যয়চাপ এখনও অব্যাহত রয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) নভেম্বর মাসের ইকোনমিক আপডেট পর্যালোচনা করে এমন চিত্র উঠে আসে।
ইকোনমিক আপডেটে বলা হয়েছে, ধানের বাজারে দাম হ্রাস খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমার অন্যতম বড় কারণ। ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে ধানের দাম তুলনামূলক বেশি থাকলেও নতুন আমন ফসল বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। সরকারি ক্রয় কার্যক্রম ও আমদানির ফলে ধানের খুচরা দাম কমতে শুরু করে। জুলাই ২০২৪-এ ধানের মূল্যস্ফীতি ছিল মাত্র ১.৩২ শতাংশ, যা ২০২৫ সালের মধ্যভাগে বেড়ে ১৬ শতাংশে পৌঁছায়। তবে অক্টোবর ২০২৫-এ তা কমে ১৩.৭৭ শতাংশে নেমে আসে। মধ্যম, সূক্ষ্ম ও মোটা ধানের দামেও একই ধরনের ওঠানামা লক্ষ্য করা গেছে।
অক্টোবর মাসে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিতে ধানের অবদান ছিল ৪৭.০১ শতাংশ, যা সেপ্টেম্বরের তুলনায় সামান্য কম। মাছ ও মাংস যথাক্রমে ৩৯.৩৩ শতাংশ ও ১৩.৪৪ শতাংশ অবদান রেখে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিপরীতে, সবজির দাম নিম্নমুখী থাকায় এর অবদান ছিল ঋণাত্মক ২০.৫৭ শতাংশ। সিরিয়ালভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, মধ্যম ধানের অবদান ১৯.৫৪ শতাংশ, মোটা ধানের ১৬.৮১ শতাংশ এবং সূক্ষ্ম ধানের ৭.২০ শতাংশ। প্রোটিনজাত পণ্যের মধ্যে মুরগি, গরু ও ইলিশের অবদান তুলনামূলক বেশি হলেও আলু ও পেঁয়াজের দাম কম থাকায় সেগুলোর অবদান ছিল ঋণাত্মক।
বিজ্ঞাপন
ব্যাংকিং খাতে ২০২৫ সালের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে আমানত ও ঋণ সম্প্রসারণ অব্যাহত রয়েছে। বছরের শুরুতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ঋণের উচ্চ সুদের কারণে তীব্র তারল্য সংকট এবং ব্যক্তিগত খাতের ঋণ চাহিদা কমে যায়। তবে আগস্ট মাসে আমানত বৃদ্ধির হার ১০.০২ শতাংশে পৌঁছে ১৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠে। সেপ্টেম্বর শেষে এ হার ছিল ৯.৯৮ শতাংশ। যদিও মাসিক আমানত বৃদ্ধির গতি কিছুটা কমেছে।
অন্যদিকে, ব্যক্তিগত খাতের ঋণ সম্প্রসারণ সেপ্টেম্বর মাসে নেমে এসেছে ৬.২৯ শতাংশে, যা বিনিয়োগে স্থবিরতার ইঙ্গিত দেয়। একই সময়ে সরকারি খাতের ঋণ সম্প্রসারণ বেড়ে ২৪.৪৫ শতাংশে পৌঁছেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকারের বাণিজ্যিক ব্যাংক নির্ভরতা কমাতে রাজস্ব সংগ্রহ জোরদার করা জরুরি, যাতে ব্যক্তিগত খাতের জন্য ঋণের সুযোগ তৈরি হয়।
সুদের ব্যবধানের দিক থেকেও বিনিয়োগে চাপ রয়ে গেছে। ২০২৫ সালে ওয়েটেড অ্যাভারেজ ইন্টারেস্ট রেট স্প্রেড বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ব্যবধান তুলনামূলক স্থিতিশীল থাকলেও বিদেশি ব্যাংকগুলোর ব্যবধান সবচেয়ে বেশি। উচ্চ সুদের ব্যবধান বিনিয়োগ ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
রাজস্ব আদায়ের চিত্র এখনও উদ্বেগজনক। অক্টোবর ২০২৫-এর জন্য রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৬ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। বাস্তবে আদায় হয়েছে ২৮ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যের তুলনায় প্রায় ৮ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা কম। আমদানি ও রফতানি রাজস্ব, স্থানীয় পর্যায়ের ভ্যাট এবং আয়কর খাতে বড় ঘাটতি দেখা গেছে। তবে ইতিবাচক দিক হলো, অক্টোবর ২০২৪-এর তুলনায় রাজস্ব আদায় ৬১৪ কোটি টাকার বেশি বেড়েছে, যা ২.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।
উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নে বরাদ্দ কমলেও ব্যবহার দক্ষতা সামান্য বেড়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে অক্টোবর পর্যন্ত উন্নয়ন ব্যয়ের বাস্তবায়ন হার ৮.৩৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যদিও মোট ব্যয়ের পরিমাণ কমেছে। সরকারি তহবিল ও প্রকল্প ঋণের ব্যবহারেও সীমিত উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বহিরঙ্গন খাতে ধীরে ধীরে শক্তিশালী হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নভেম্বর ২০২৪ থেকে অক্টোবর ২০২৫ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। গ্রস রিজার্ভ ২৪.৩৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩২.৩৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। একই সময়ে বিপিএম-৬ মান অনুযায়ী রিজার্ভ ১৮.৬১ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭.৫৮ বিলিয়ন ডলারে। এটি বৈদেশিক সুরক্ষা জোরদারের ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
রেমিট্যান্স প্রবাহও অর্থনীতিকে সহায়তা করছে। ২০২৬ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে প্রবাসী আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে রেমিট্যান্স ২.৬৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায় এবং অক্টোবরেও দুই দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলারের বেশি থাকে, যা আগের বছরের তুলনায় অনেক বেশি।
রফতানি আয়ে এখনও অস্থিরতা থাকলেও অক্টোবর ২০২৫-এ মাঝারি পুনরুদ্ধার লক্ষ্য করা গেছে। তৈরি পোশাক খাত ও অ-আরএমজি উভয় ক্ষেত্রেই মধ্যবছরের ধীরগতি কাটিয়ে কিছুটা উন্নতি দেখা যাচ্ছে। তবে প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার বৃদ্ধির ফলে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় কিছুটা চাপ তৈরি হয়েছে।
ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের মতে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত না হলে নতুন কোনো বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অনেকেই এখন নির্বাচন-পরবর্তী সময়ের দিকে তাকিয়ে আছেন—তখন নীতিগত দিকনির্দেশনা, অর্থনৈতিক প্রবাহ ও সামগ্রিক ব্যবসায়িক পরিবেশ কোন পথে যায়, সেটি দেখেই তারা পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে চান। এ অবস্থায় ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা, ঋণখেলাপির পরিমাণ বৃদ্ধি এবং ডলারের কৃত্রিম সংকট পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। সুদহার তুলনামূলকভাবে স্থির থাকলেও ঋণপ্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে, যা বিনিয়োগে স্থবিরতার অন্যতম বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অক্টোবর ২০২৫ পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতার পথে এগোচ্ছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমেছে, রিজার্ভ ও রেমিট্যান্স শক্তিশালী হয়েছে, তবে বিনিয়োগ, রাজস্ব সংগ্রহ ও ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নীতিগত স্পষ্টতা নিশ্চিত করা যায়, তবে অর্থনৈতিক গতিশীলতা আরও জোরদার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, সরকার ব্যবসায়ীদের চরম সংকট প্রত্যক্ষ করলেও কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারছে না। ২০২২ সালের পর থেকে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংকট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে অধিকাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠান নিয়মিত উৎপাদন ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত। ইতোমধ্যে ক্ষুদ্র শিল্পের প্রায় অর্ধেক বন্ধ হয়ে গেছে বলে তিনি দাবি করেন। উচ্চ সুদহার, মুদ্রাস্ফীতি ও জ্বালানি সংকট একযোগে শিল্প খাতের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করছে, যার প্রভাব পড়ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সামগ্রিক শিল্প কার্যক্রমে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানো এবং শিল্পখাতের বৈচিত্র্য আনতে সরকারকে আরও উদার নীতি গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, একটি দেশের স্থিতিশীলতার জন্য গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতি ও রাজনীতি একে অপরের পরিপূরক এবং সমান্তরালভাবে চলে। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ যত দীর্ঘ হবে, অর্থনীতির ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব তত গভীর হবে।
এএইচ/এএস

