বাংলাদেশে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) বিপুল পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিনিয়োগ দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও পরিবেশগত স্থিতিশীলতাকে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে ফেলছে বলে নতুন এক প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এ খাতে এডিবির সীমিত বিনিয়োগ ও নীতিগত উদাসীনতা বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। রাজধানীর বাংলাদেশ সামরিক জাদুঘরে অনুষ্ঠিত তিনদিনব্যাপী বাংলাদেশ এনার্জি কনফারেন্স ২০২৫–এর দ্বিতীয় দিনের সেশনে এই প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।
বিজ্ঞাপন
‘বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে বহুজাতিক ব্যাংক’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন এনজিও ফোরাম অন এডিবির কো-অর্ডিনেটর শারমিন আক্তার বৃষ্টি। সেশনটি পরিচালনা করেন সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক রায়ান হাসান। তিনি বলেন, ‘এডিবি’র একপেশে জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর বিনিয়োগ মডেল বাংলাদেশকে জ্বালানি ঘাটতি, বাড়তি ঋণঝুঁকি এবং জলবায়ু বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। প্রতিবেদনে জানানো হয়, দক্ষিণ এশিয়ায় এডিবির মোট বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতির মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ১৭.৩৪ বিলিয়ন ডলার, যার বড় অংশই গ্যাস-সংশ্লিষ্ট খাতে গেছে। গ্যাসভিত্তিক ৩৬টি প্রকল্পে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলারের অর্থায়নের মাধ্যমে ৩,৬৫৯ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। এই বিনিয়োগের অধিকাংশই টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স স্পেশাল ফান্ড এবং উচ্চ সুদের ওসিআর ঋণ থেকে এসেছে, যা দেশের ঋণঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে।’
রোববার বাংলাদেশ মিলিটারি মিউজিয়ামের একটি অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।
প্রতিবেদনে গ্যাস সংকট ও অবকাঠামো ঘাটতির কারণে কয়েকটি বড় প্রকল্পের অচলাবস্থার বিষয়ও উঠে আসে। রূপসা ৮০০ মেগাওয়াট ও রিলায়েন্স মেঘনাঘাট ৭১৫ মেগাওয়াট কেন্দ্র নির্মাণ সম্পন্ন হলেও জ্বালানির অভাবে চালু করা যায়নি। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও এসব প্রকল্পের বিপরীতে বাংলাদেশকে উচ্চমাত্রার ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হচ্ছে। রায়ান হাসান বলেন, ‘বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রস্তুত থাকলেও জ্বালানি না থাকায় সেগুলো চালু করা যাচ্ছে না— এটাই জ্বালানি নিরাপত্তাহীনতার সবচেয়ে ব্যয়বহুল উদাহরণ।’
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, এডিবি–সমর্থিত পাঁচটি গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রের জীবনচক্রে মোট কার্বন নিঃসরণ দাঁড়ায় প্রায় ১৭৫ মিলিয়ন টন। পাশাপাশি মেঘনা, মেঘনাঘাট ও ভৈরব নদীর তীরে ১৬০ একরের বেশি জমি দখলের ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠী জীবিকা হারানো, বাস্তুচ্যুতি ও সামাজিক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে। যদিও এডিবি গ্যাস খাতে ৯১ শতাংশের বেশি অর্থায়ন করেছে, নবায়নযোগ্য খাতে তাদের বিনিয়োগ মাত্র ৮.৬৬ শতাংশ— যা দেশের টেকসই জ্বালানি ভবিষ্যতের জন্য চরম অপ্রতুল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা ও নীতিগত প্রতিবন্ধকতা নিয়ে আয়োজিত পৃথক সেশনে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও নীতি জটিলতা, শুল্ক কাঠামো এবং অদৃশ্য বাধার কারণে এ খাতের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আর্থের নির্বাহী পরিচালক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘শিল্প প্রতিষ্ঠানের সোলার স্থাপনায় গুরুত্ব বাড়লেও ঘরোয়া পর্যায়ের প্রায় ৯০ শতাংশ রুফটপ সোলার সিস্টেম কার্যকর নয়। এগুলো নীতি পূরণের জন্য প্রতীকীভাবে বসানো হলেও সঠিকভাবে চালু থাকলে জাতীয় গ্রিডে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদ্যুৎ যোগ করা যেত।’
বাংলাদেশ সোলার অ্যান্ড রিনিউয়েবল এনার্জি অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মোস্তাফা আল মাহমুদ বলেন, ‘সৌরশক্তিতে বিনিয়োগ বাড়াতে শক্তিশালী আর্থিক প্রণোদনা প্রয়োজন। সৌর প্যানেল ও যন্ত্রপাতির ওপর শুল্ক কমানোর বিষয়ে আলোচনা হলেও কোনো বাস্তব পদক্ষেপ না নেওয়া অগ্রগতির পথে অদৃশ্য বাধার ইঙ্গিত দেয়।’
এডিবি’র ২০২১ সালের এনার্জি পলিসির সংশোধনগুলোর মধ্যেও উচ্চঝুঁকির ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা। পারমাণবিক অর্থায়ন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, ক্রিটিক্যাল মিনারেল সরবরাহ শৃঙ্খলা সমর্থন, কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তির অনুমোদন এবং তেল–গ্যাস খাতে মিথেন লিকেজ কমাতে অর্থায়নের মতো সিদ্ধান্তগুলোকে তারা দক্ষিণ এশিয়ার টেকসই জ্বালানি রূপান্তরের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুতি হিসেবে দেখছেন।
সামগ্রিকভাবে বক্তারা বলেন, এডিবি’র জীবাশ্ম-নির্ভর কৌশল পরিবর্তন করে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি। নীতিগত বাধা দূরীকরণ, আর্থিক প্রণোদনা এবং স্বচ্ছ নীতিমালা প্রণয়ন ছাড়া বাংলাদেশে টেকসই জ্বালানির রূপান্তর সম্ভব নয়।
এমআর/এফএ

