রোববার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

‘দেশে বছরে তিন হাজার কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন করে তামাক কোম্পানি’

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৪:৩৫ পিএম

শেয়ার করুন:

‘দেশে বছরে তিন হাজার কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন করে তামাক কোম্পানি’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কোম্পানির আগ্রাসনে বাড়ছে তামাক চাষ, জনস্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তায় হুমকি’ শীর্ষক সেমিনার। ছবি: সংগৃহীত

দেশের তামাক বাজারে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আধিপত্য, ঘোষণাবহির্ভূত বিক্রি, কর ফাঁকি, রফতানিতে কর ছাড় এবং কৃষকের শোষণের কারণে বছরে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন হয় বলে অভিযোগ তুলেছেন জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা। 

বিশেষজ্ঞদের দাবি, তামাক থেকে সরকারের যে রাজস্ব আসে তার তুলনায় বহুগুণ বেশি ক্ষতি হয় জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও কৃষি অর্থনীতিতে। সব মিলিয়ে দেশে বছরজুড়ে ক্ষতির পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকারও বেশি। তামাক কোম্পানিগুলো কর না বাড়ানোর জন্য চোরাচালানের অজুহাত দেখালেও বাস্তবে চোরাচালানের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয় না এবং এর সঙ্গে প্রভাবশালী অংশের মদদ রয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তারা।


বিজ্ঞাপন


বুধবার (৫ নভেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরো (বিইআর) সম্মেলন কক্ষে ‘কোম্পানির আগ্রাসনে বাড়ছে তামাক চাষ, জনস্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তায় হুমকি’ শীর্ষক সেমিনারে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। 

অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরো, বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরাম (বিএজেএফ) এবং বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসি (বিএনটিটিপি)।

সেমিনারে গবেষকরা জানান, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম সস্তা তামাকপাতা উৎপাদনকারী দেশ। প্রতি কেজির দাম মাত্র ১ দশমিক ৬৮ ডলার হওয়ায় কৃষক কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন, অথচ বহুজাতিক কোম্পানিগুলো দেশে-বিদেশে বিপুল মুনাফা অর্জন করছে। দেশে মাত্র কয়েকটি কোম্পানি পুরো সিগারেট বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, কিন্তু তারা যে পরিমাণ কর দেয় তার তুলনায় অবৈধ লেনদেন ও কর ফাঁকির পরিমাণ অনেক বেশি। 

রফতানির ক্ষেত্রে কর মওকুফ, এমআরপির বাইরে বিক্রি এবং বাজারে দামের কারসাজির ফলে তামাক চাষে কৃষকের ওপর নির্ভরতা আরও বাড়ছে। খাদ্যশস্যের জমি ধ্বংস হয়ে তামাক উৎপাদন বাড়ছে, পাহাড়ি এলাকাতেও তামাক চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি বলে জানান বক্তারা। 


বিজ্ঞাপন


বক্তারা বলেন, তামাক কোম্পানিগুলো দাবি করে কর বাড়ালে চোরাচালান বাড়বে, কিন্তু বাস্তবে চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত কাউকে ধরতে দেখা যায় না। তাদের অভিযোগ, সরকারের প্রভাবশালী একটি অংশ এই শিল্পকে নানাভাবে সহায়তা দিচ্ছে। এমনকি নিকোটিন কারখানা স্থাপনেরও অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে, যা বিদ্যমান আইন লঙ্ঘন করেই করা হচ্ছে। ফলে বাজার আরও বিস্তার লাভ করছে এবং কোম্পানিগুলো নামমাত্র কর দিয়ে হাজার কোটি টাকার বেশি মুনাফা তুলছে। সিগারেটের খুচরা বাজারেও দাম বাড়ানোর অজুহাতে ভোক্তাকে অতিরিক্ত অর্থ দিতে হচ্ছে, অথচ এই বাড়তি দাম সরকারি কোষাগারে না গিয়ে সরাসরি কোম্পানির মুনাফায় যোগ হচ্ছে।

বক্তারা জানান, তামাক চাষ কমাতে কৃষকদের বিকল্প ফসল চাষে সহায়তা জরুরি। খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষায় উর্বর জমিতে তামাক উৎপাদন বন্ধ করা, নিকোটিন কারখানার অনুমোদন প্রত্যাহার, এমআরপি’র বাইরে বিক্রি বন্ধ, রফতানিতে কর আরোপ এবং কর ফাঁকি রোধে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। তাদের মতে, তামাক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণহীন বাজার পরিচালনা থামাতে সরকারকে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে, নয়তো দীর্ঘমেয়াদে এই খাত দেশের স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতে ভয়াবহ ক্ষতি ডেকে আনবে।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনে বিএনটিটিপির টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য ও গবেষক সুশান্ত সিনহা জানান, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম সস্তা তামাকপাতা উৎপাদনকারী দেশ। প্রতি কেজির দাম মাত্র ১.৬৮ ডলার, ফলে কৃষক কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন, অথচ বহুজাতিক কোম্পানিগুলো দেশে-বিদেশে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করছে। দেশে মাত্র কয়েকটি কোম্পানিই প্রায় পুরো সিগারেট বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। রপ্তানিতে কর মওকুফ ও দামের কারসাজির কারণে কৃষক ক্রমেই বড় কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন, যা খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির জন্য বড় হুমকি।

বিএনটিটিপির টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য ও ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিসের সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, বছরে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার লুকানো লেনদেন হয়, যা করের বাইরে থেকে যায়। কোম্পানিগুলো দাবি করে—কর বাড়ালে চোরাচালান বেড়ে যাবে, দরিদ্র মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু বাস্তবে চোরাচালানে জড়িত কেউ ধরা পড়ে না। প্রভাবশালী একটি অংশ এই শিল্পকে মদদ দিচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। 
 
মাহবুবুল আলম অভিযোগ করেন, সরকার নিকোটিন কারখানা চালুর অনুমোদন দিচ্ছে, যা বিদ্যমান আইনের লঙ্ঘন। পাহাড়ি এলাকা ও উর্বর কৃষিজমিতে তামাক চাষ ছড়িয়ে পড়ছে, ফলে দরিদ্রতা, জমি নষ্ট এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে—আর এই সুযোগে কোম্পানিগুলো অস্বাভাবিক মুনাফা তুলছে।

বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি সাহানোয়ার সাইদ শাহীন সেমিনারে বলেন, তামাক চাষ থেকে বছরে মোট ক্ষতির পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকার মতো। শুধুমাত্র স্বাস্থ্য খাতে ক্ষতি প্রায় চল্লিশ হাজার কোটি টাকা। কৃষকের স্বাস্থ্যঝুঁকি, জমি উর্বরতা নষ্ট হওয়া, পরিবেশ দূষণ, রফতানিতে কর ছাড়, সিএসআর ব্যয়ের নামে প্রচারণা, অর্থনৈতিক সুযোগ ক্ষতি ও কর ফাঁকি—সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি বিপদের মুখে পড়ছে। কৃষকরা প্রকৃত মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, আর মুনাফা তুলছে বড় কোম্পানিগুলো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বিইআর আহ্বায়ক ড. রুমানা হক বলেন, সরকার তামাক থেকে যে কর পায় তা প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা, কিন্তু তামাকজনিত রোগ, চিকিৎসা ব্যয় ও কর্মক্ষমতা হারানোর ক্ষতি বছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। অর্থাৎ জনগণের জীবন ও স্বাস্থ্য ব্যয় রাজস্ব আয়ের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। 

রুমানা হক বলেন, সিগারেট চোরাচালান তেমন ঘটে না, বরং এটি কর না বাড়ানোর অজুহাত। কর বাড়লে ভোগ কমবে, স্বাস্থ্যের ঝুঁকি কমবে এবং সরকারও বড় অংকের রাজস্ব পাবে। তিনি এমআরপি নিয়ন্ত্রণ, সঠিক কর কাঠামো বাস্তবায়ন ও বাজার মনিটরিং জোরদারের ওপর গুরুত্ব দেন।

অনুষ্ঠানে আরও ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আবু খালিদ, তামাক কর প্রকল্পের সিনিয়র প্রজেক্ট অ্যান্ড কমিউনিকেশন অফিসার ইব্রাহীম খলিলসহ বিভিন্ন গবেষক, সাংবাদিক ও অর্থনীতিবিদ।

এএইচ/ক.ম 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর