নেতৃত্ব সংকটে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)। ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অসুস্থতার কথা বলে পদত্যাগ করেন তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম। এরপর থেকে প্রশাসক নিয়োগ করে টেনেটুনে চলছে সংগঠনটির কার্যক্রম। ১২০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের কথা থাকলেও ১৪ মাসেও তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ফলে কার্যত অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে সংগঠনটিতে। এরই মধ্যে নতুন করে আবার প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। শিগগির তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় দুই মাস ধরে অভিভাবকহীন অবস্থায় রয়েছে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনটি। ফলে নেতৃত্ব সংকটে ব্যাহত হচ্ছে নীতিনির্ধারণ ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম। এমনকি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদানও অনিয়মিত হয়ে পড়েছে।
বিজ্ঞাপন
জাতীয় নির্বাচনের আগে ভোটের সম্ভাবনা ক্ষীণ
অভিযোগ রয়েছে, নানা অজুহাতে সংগঠনের নির্বাচন পেছানোর পাঁয়তারা করছে ব্যবসায়ীদের একটি গ্রুপ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নির্বাচন বিধিমালা পরিবর্তনের পর নাখোশ হয়েছেন অনেকে। তারা এটির সংস্কার দাবি করেন। এমনকি নির্বাচন যেন না হয় সেজন্য হাইকোর্টে অন্তত সাতটি মামলা করেন তারা।
নির্বাচনে অচলাবস্থা নিরসন হোক-এমনটিও চায় ব্যবসায়ীদের অপর একটি গ্রুপ। তারা বলছেন, নির্বাচন বানচালে যারা পরিকল্পনা করছে তাদের আগে বুঝতে হবে কোনটা আমাদের জন্য আগে কল্যাণকর।
এবিষয়ে এফবিসিসিআইয়ের মহাসচিব মো. আলমগীর ঢাকা মেইলকে জানান, এখানে নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে। ব্যবসায়ীদেরই একটি গ্রুপ নির্বাচন ঠেকাতে আদালতে সাতটি মামলা করেছে। গ্রুপিং ও আইনি জটিলতায় নির্বাচন এখন অনিশ্চিত। জাতীয় নির্বাচনের আগে এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচন না হওয়ার সম্ভাবনাই তিনি দেখছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন প্রশাসক নিয়োগ হলো মাত্র। তিনি দেশে এসে দায়িত্ব বুঝে নেবেন। তারপর নির্বাচন নিয়ে ভাববেন। তফসিল ঘোষণা করলেও মনে হয় না নির্বাচন বাস্তবায়ন করতে পারবেন। কারণ সামনেই সংসদ নির্বাচন। এর আগ মুহূর্তে নির্বাচন আয়োজন কঠিন হয়ে পড়বে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ৯০ দিন সময় লাগবে। ফলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সঙ্গে মিলে গেলে এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচন আরও পিছিয়ে যেতে পারে। এতে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের আগে নেতৃত্ব পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে মনে করছেন অনেকেই।
নেতৃত্ব সংকট, বারবার প্রশাসক নিয়োগ
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম পদত্যাগ করলে সংগঠনটির পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পরে প্রতিযোগিতা কমিশনের সদস্য ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. হাফিজুর রহমানকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তার দায়িত্ব ছিল ১২০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে নতুন পর্ষদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা। তবে একাধিকবার সময় বাড়িয়েও তিনি নির্বাচন আয়োজন করতে ব্যর্থ হন। সর্বশেষ গত ৭ সেপ্টেম্বর নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও তা আর আলোর মুখ দেখেনি। তার মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ১০ সেপ্টেম্বর। এরপর থেকে ব্যবসায়ীদের এই শীর্ষ সংগঠনের শীর্ষ পদ শূন্য। ইতোমধ্যে কেটে গেছে প্রায় দুই মাস। অভিভাবকহীন হয়ে নানা জটিলতায় পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। বন্ধ হয়ে পড়েছে নীতি সহায়তা কার্যক্রম। সভাপতি কিংবা প্রশাসক না থাকায় সংগঠনটি কার্যত অচলাবস্থায় পড়েছে।
আরও পড়ুন
ফের অস্থির হচ্ছে দেশের অর্থনীতি
সম্প্রতি বাণিজ্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ফের প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে। এবার নতুন দায়িত্বে আসছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে রফতানি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব আব্দুর রহিম খান। তিনি ঢাকা মেইলকে তার নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, আমাকে নতুন করে এফবিসিসিআইয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে আমি বিদেশ সফরে আছি। দেশে ফিরেই দায়িত্ব গ্রহণ করব।
আব্দুর রহিম খান বলেন, আমার মেয়াদ এক বছর থাকবে, তবে নিয়ম অনুযায়ী ১২০ দিনের মধ্যেই নির্বাচন করার চেষ্টা করব।
নিষ্ক্রিয়তায় নীতি সহায়তা থেকে বঞ্চিত ব্যবসায়ীরা
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনটির প্রধান কাজ হলো বেসরকারি খাতের স্বার্থ রক্ষা করা এবং সামগ্রিক ব্যবসা উন্নয়নে সহায়তা করা। সংগঠনটির কাজের মধ্যে রয়েছে সরকারের নীতি-নির্ধারণী ফোরামে গঠনমূলক পরামর্শ দেওয়া, শিল্প-বাণিজ্য ও বিপণনব্যবস্থার উন্নয়নে গবেষণা করা এবং বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংগঠন ও চেম্বারসমূহকে একত্রিত করা। পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন নীতি-নির্ধারণী ফোরামে গঠনমূলক পরামর্শ দিয়ে জাতীয় অর্থনীতির অগ্রগতিতে অবদান রাখা। ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষায় সরকারের সঙ্গে দরকষাকষি এবং নীতিগত সহায়তা আদায় করা। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংগঠন ও চেম্বারসমূহকে একটি ছাতার নিচে এনে সামগ্রিক ব্যবসা উন্নয়নে কাজ করা।
কিন্তু নেতৃত্ব সংকটে থাকা শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনটি ধুঁকে ধুঁকে মরছে। ফলে ব্যবসায়ীরা বঞ্চিত হচ্ছেন নীতিগত সহায়তা থেকে। নেতৃত্বহীন এফবিসিসিআইয়ের কারণে সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের নীতি আলোচনার চ্যানেল ভেঙে পড়েছে। ফলে বাণিজ্য নীতিতে একতরফা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার। এর প্রভাব পড়ছে রফতানি, শিল্পোন্নয়ন ও কর্মসংস্থানে।
তিলে তিলে ধ্বংস হচ্ছে সংগঠনটি, বলছেন ব্যবসায়ীরা
ব্যবসায়ীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, একটি গোষ্ঠী ফেডারেশনকে ইচ্ছাকৃতভাবে নেতৃত্বশূন্য রাখছে। তারা তিলে তিলে সংগঠনকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এফবিসিসিআই নির্বাচন নিয়ে যা হচ্ছে, তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।
ব্যবসায়ীরা জানান, এফবিসিসিআইকে বিগত সরকার রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। গণভবনরে পছন্দে তখন সভাপতি নির্ধারণ করা হতো। তবে এবার রাজনৈতিক সরকার না থাকায় চিত্র উল্টো। এ কারণে নির্বাচন হতে দিচ্ছে না একটি গ্রুপ।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, ব্যবসায়ীদের সংগঠন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না থাকা ভালো। এতে দেশের শিল্প, ব্যবসার উন্নয়ন এবং সম্প্রসারণের দিকে মনোযোগ দেওয়া যায়। অনেক দিন ধরে পর্ষদ সক্রিয় না থাকায় ব্যবসায়ীরা তাদের দাবি-দাওয়া সরকারের কাছে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে পারছে না জানান ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা।
ব্যবসায়ী নেতারা জানান, শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ে নিজেদের প্রতিনিধি না থাকায় সরকারের বিভিন্ন দফতরে হয়রানির শিকার হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এমনকি অনেক বাণিজ্য সংগঠনের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সুযোগ নিয়ে প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে বলেও তারা অভিযোগ করেন।
হকস বে’র চেয়ারম্যান ও বারভিডার সভাপতি আব্দুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আসন্ন নির্বাচনে আমি সভাপতি পদপ্রার্থী। আমরা চাই এফবিসিসিআই সক্রিয় হয়ে উঠুক। ব্যবসায়ীদের দাবি-দাওয়া ও নীতি সহায়তায় দিয়ে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের সংকট দূর করুক।’
তিনি অভিযোগের সুরে বলেন, ‘সংগঠনটি এভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার বিষয়টি আমাদের জন্য হতাশাজনক। নিষ্ক্রিয় থাকায় নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে ব্যবসায়ীরা প্রতিনিধিত্ব করতে পারছেন না, বিধায় বেসরকারি খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকার নিজেদের মতো করে বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন করছে। এফবিসিসিআই নেতৃত্ব সংকটের কারণে কোনো ভূমিকা নিতে পারছে না। এতে সার্বিক অর্থনীতিতে খারাপ প্রভাব পড়বে।’
সিগনেটরি জটিলতায় ভোগান্তি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের
প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ভোগান্তিতে পড়ছেন। নেতৃত্ব সংকটের পাশাপাশি এফবিসিসিআইয়ে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। নেতৃত্ব না থাকায় কর্মচারীদের বেতন সিট সই করা ইস্যুতে জটিলতার সৃষ্টি হয়।
এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসকের অবর্তমানে বর্তমানে সংগঠনটির দায়িত্বে আছেন এফবিসিসিআই সচিব মো. আলমগীর। বর্তমানে তিনি চীন সফরে রয়েছেন বলে জানা গেছে। ফলে ফেডারেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন নিয়ে আরও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
তথ্য মতে, বর্তমানে এফবিসিসিআইতে ৪০ জন কর্মকর্তা এবং ১০ জন কর্মচারী রয়েছেন। এছাড়া ১০ জন আউটসোর্সিং (চুক্তিভিত্তিক) কর্মী রয়েছেন। তবে সংগঠনটির প্রশাসকের দফতর থেকে জানানো হয়েছে, নতুন প্রশাসক জয়েন করলে বেতন-ভাতা দিতে পারবেন। এছাড়া ২০২০ সালে তৎকালীন সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম ৬২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করেছিলেন। তাদের চাকরি পুনর্বহালের দাবির বিষয়টি এখনো ঝুলে আছে। সেটিরও কোনো সুরাহা হয়নি।
নির্বাচনের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে এফবিসিসিআইয়ের মহাসচিব মো. আলমগীর ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আসলে এখানে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার পরও নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন বাস্তবায়ন করা যায়নি। এটা ব্যবসায়ীদের সংগঠন। আর ব্যবসায়ীদেরই একটা গ্রুপ চায় না নির্বাচন হোক। তারা হাইকোর্টে সাতটি মামলা করেছে। মামলা চলমান। আদালতের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি আমরা। গ্রুপিং জটিলতায় নির্বাচন এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।’
আলমগীর বলেন, ‘হয়তো জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পর্যন্ত অপেক্ষা করা লাগতে পারে।’
সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ অতিরিক্ত মহাসচিব শাহ আব্দুল খালেক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘গত বছর ৫ আগস্টের পর সভাপতি পদত্যাগ করলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রশাসক নিয়োগ দেয়। তার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় এবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রফতানি অনুবিভাগ) আব্দুর রহিমকে নতুন প্রশাসক করা হয়েছে। যদিও তিনি এখনো দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। আশা করা যায় ভালো কিছু হবে।’
এমআর/জেবি

