শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ব্যাংক খাতে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ৩ হাজার ৪৮৩ জন

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ১২:১৫ পিএম

শেয়ার করুন:

ব্যাংক খাতে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ৩ হাজার ৪৮৩ জন

দেশের ব্যাংক খাতে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪৮৩ জনে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবারই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে এই তথ্য প্রকাশ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই তালিকা প্রকাশের পরই স্পষ্ট হচ্ছে ব্যাংক খাতের নাজুক অবস্থার প্রকৃত চিত্র।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে ঋণখেলাপি চক্রের লুকানো হিসাব। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০২৫ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকা— যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩৩ শতাংশ। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে খেলাপির পরিমাণ তিনগুণ বেড়ে যাওয়ায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে ব্যাংক খাতে আরও বড় বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।


বিজ্ঞাপন


সূত্র জানায়, বছরের পর বছর রাজনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলো ব্যাংক থেকে কয়েক লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল, কিন্তু সেগুলোর বড় অংশই খেলাপি হিসেবে দেখানো হয়নি। এখন সেই গোপন হিসাব বেরিয়ে আসছে। ২০২৫ সালের জুনে ব্যাংক খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ২০ লাখ ৪৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। ওই সময় তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা, আর এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৪ লাখ ৫৫ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের জুনে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা।

বিশ্লেষকদের মতে, ঋণখেলাপিদের লাগামহীন কর্মকাণ্ডের কারণে ব্যাংকগুলো মারাত্মক তারল্য সংকটে পড়েছে। নতুন ঋণ বিতরণে অনীহা দেখা দিচ্ছে, যার ফলে ব্যবসা ও বিনিয়োগ ব্যাহত হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা উচ্চ সুদের চাপে পড়ছেন, অথচ প্রভাবশালী খেলাপিরা পার পেয়ে যাচ্ছেন বারবার। এতে আমানতকারীদের মধ্যেও নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, খেলাপি ঋণ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার পেছনে কয়েকটি বড় কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম— আগের সরকারের সময়ে অনেক ঋণ নামে-বেনামে দেওয়া হয়েছিল, যা গোপন রাখা হয়েছিল। এখন সেগুলো প্রকাশ পাচ্ছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী, খেলাপি ঘোষণার সময়সীমা ছয় মাস থেকে কমিয়ে তিন মাস করা হয়েছে, ফলে খেলাপির অঙ্ক দ্রুত বেড়েছে। কৃষি ও এসএমই ঋণে বিশেষ ছাড়ও বাতিল করা হয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, গত ১৬ বছরে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বিপুল পরিমাণ ঋণ বিতরণ হলেও তার বড় অংশ উৎপাদনমুখী খাতে ব্যবহার হয়নি। অনেকে সেই অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন, কেউবা পলাতক রয়েছেন। আবার যেসব ব্যবসায়ী রাজনৈতিক চাপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তারা এখনও খেলাপির খাতা থেকে মুক্ত হতে পারেননি। বিশেষজ্ঞরা এটিকে একটি ‘সংক্রমণকাল’ হিসেবে দেখছেন এবং আশা করছেন— আগামী কয়েক প্রান্তিকের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য সচল হলে খেলাপির প্রবৃদ্ধি কমে আসবে।


বিজ্ঞাপন


বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপির হার দাঁড়িয়েছে ৪৫ শতাংশ, যা গত ডিসেম্বরে ছিল ৪২.৮৩ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপির হার বেড়ে ২০ শতাংশে পৌঁছেছে, যা গত ডিসেম্বরে ছিল ১৫.৬০ শতাংশ।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সময় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এরপর ধারাবাহিকভাবে তা বেড়েই চলেছে। দীর্ঘদিন ধরেই অর্থনীতিবিদরা অভিযোগ করে আসছিলেন, রাজনৈতিক প্রভাবে ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ বের করে নিয়েছেন এবং তার একটি বড় অংশ বিদেশে পাচার হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক সূত্র জানায়, সাবেক সরকারের ঘনিষ্ঠ ও বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম এবং নাসা গ্রুপের প্রভাবমুক্ত হওয়ার পর তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংকগুলোর প্রকৃত চিত্র প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংকে খেলাপি ঋণ এখন রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে।

খেলাপি ঋণের এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে অনেক ব্যাংকই মারাত্মক তারল্য সংকটে পড়েছে। নতুন করে বেসরকারি খাতে ঋণ দেওয়ার সক্ষমতাও হারাচ্ছে তারা। এতে নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান ব্যাহত হচ্ছে, যা সামগ্রিক অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে পাঁচটি দুর্বল ব্যাংককে একীভূত বা মার্জ করার প্রস্তুতি চূড়ান্ত করেছে— খেলাপি ঋণের ভয়াবহতা সামাল দিতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

টিএই/এফএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর