গত কয়েক অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানি আয়ে ধারাবাহিকভাবে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে যেখানে মোট রফতানি আয় ছিল ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ গত ৫ বছরে ব্যবধানে রফতানি আয় বেড়েছে ৪৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
এছাড়া এককভাবে তৈরি পোশাক সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে রফতানি আয়ে। গত ৫ বছরে পোশাক শিল্পে রফতানি আয় বেড়েছে ৪০ দশমিক ৮ শতাংশ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
বিজ্ঞাপন
ইপিবি তথ্য মতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে (জুলাই-জুন) ৪৮ বিলিয়ন ডলার বা ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করেছেন দেশের উদ্যোক্তরা। রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে ৪৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছিল।
- ৫ বছরে রফতানি আয় বেড়েছে ৪৩.৩৯ শতাংশ
- ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রফতানি প্রবৃদ্ধি ৮.৫৮ শতাংশ
- ৫ বছরে পোশাক শিল্পে রফতানি আয় বেড়েছে ৪০.৮ শতাংশ
- ২০২৪-২৫ অর্থবছে পোশাক খাতে ৮.৮৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি
- কৃষি, প্লাস্টিক ও হোমটেক্সেও ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি
তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে রফতানি আয়ে সবচেয়ে বড় লাফ দেখা গেছে। ওই বছর মোট রফতানি আয় ৫২.০৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৩৪.৪৩ শতাংশ বেশি। মূলত পোশাক খাতে ৪২.৬১ বিলিয়ন ডলারের রফতানিই এই প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকা শক্তি ছিল।
তবে ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সামান্য মন্দা দেখা গেলেও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আবার রপ্তানি আয় কিছুটা বেড়েছে। এ বছর মোট রফতানি হয়েছে ৪৮.২৮ বিলিয়ন ডলার এবং এর মধ্যে পোশাক খাত থেকে এসেছে ৩৯.৩৪ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে গত অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরু থেকেই দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এর মধ্যেও রফতানি আয়ে তৈরি পোশাক খাত বড় অবদান রেখেছে।
বিদায়ী অর্থবছরে পোশাক রফতানি হয়েছে ৩৯ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারের, যা ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। এর মধ্যে নিট তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে ২১ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। আর ওভেন তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে ১৮ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার, এখাতে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৮২ শতাংশ।

বিদায়ী অর্থবছরের শুরুর দিন (জুলাই) থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। যা এক পর্যায়ে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’-এ রূপ নেয়। অভ্যুত্থানকালে ইন্টারনেট বন্ধ রাখা ও কারখানা ছুটির রাখার মতো ঘটনা ঘটে। এ সময় ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের সমস্যায় পড়েন তৈরি পোশাক কারখানার উদ্যোক্তারা। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটলে প্রায় তিন দিন দেশ কার্যত সরকারবিহীন ছিল। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়। এরপর দীর্ঘসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেকটা নিষ্ক্রিয় থাকার কারণে অস্থিরতা ছিল দেশে। তখন নানা সংকটে অনেক কারখানা বন্ধ রাখতে হয়। শেষ অবধি বেশ কিছু কারখানা বন্ধও হয়ে যায়। এমন সংকটের বছরেও তৈরি পোশাক রফতানিতে ইতিবাচক ধারা দেখলেন উদ্যোক্তারা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সামগ্রিক রফতানি আয়ের বড় অংশই পোশাক শিল্প থেকে আসে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎস। মাঝে কিছুটা ধীরগতি দেখা গেলেও সামগ্রিকভাবে রফতানি আয়ে ইতিবাচক ধারা বজায় রয়েছে।
আরও পড়ুন-
তারা চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা হিসেবে দেখেছেন, বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা, মূল্যস্ফীতি, এবং কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির প্রভাব থাকলেও বাংলাদেশের পোশাক খাত তার অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। একইসঙ্গে রফতানি পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ এখন সময়ের দাবি।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, বাংলাদেশের রফতানি খাত বিশেষত পোশাক শিল্প একটি মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সামগ্রিকভাবে রফতানি আয় বাড়ছে এবং ভবিষ্যতে এই ধারা বজায় রাখার জন্য আরও নতুন বাজার খুঁজে বের করা, উৎপাদনশীলতা বাড়ানো এবং পণ্যের বৈচিত্র্য নিশ্চিত করাই হবে মূল চ্যালেঞ্জ।
এছাড়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কৃষিজাত পণ্য রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৫২ শতাংশ, পোশাক খাতে ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ, প্ল্যাস্টিক পণ্যে ১৬ দশমিক ২১ শতাংশ, হোম টেক্সটাইলে ২ দশমিক ৪২ শতাংশ প্রবদ্ধি হয়েছে। অন্যদিকে পাটজাত পণ্যে ৪ দশমিক ১০ শতাংশ, কাচজাত পণ্যে ৩৮ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
রফতানি আয়ে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা গেলেও অদূও অবিষ্যতে নেতিবচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে তৈরি পোশাক রফতানিকারক সমিতি-বিজিএমইএ। সংগঠনটির পরিচালক ফয়সাল সামাদ বলেন, গত বছর জুলাই অভ্যুত্থান সময়কালীন রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ইতিবচক প্রবৃদ্ধিও কারণ হচ্ছে পূর্বের হাতে থাকা কার্যাদেশগুলো উৎপাদন ও রফতানি করা হয়। ফলে গত অর্থবছরের বড় সময় ধরে অস্থিতিশীলতা মোকাবিলা করা লাগলেও রফতানি বেড়েছে।
তিনি বলেন, আগের নির্বাচনের পর স্থিতিশীলতা এলে ক্রেতারা যথেষ্ট কার্যাদেশ দিয়েছিল। এরপর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হলেও হাতে যথেষ্ট সেই কাজ ছিল। তবে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকালে বা পরবর্তীতে কার্যাদেশ কমেছে। যার প্রভার পড়া শুরু হয়ে গেছে। অর্থবছরের শেষ মাসে এসে রফতানি আয়ে নেতিবাচক ধারা দেখা গেছে।
আগের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে কার্যাদেশ কমে যাওয়ার প্রতিফলন নতুন অর্থবছরওে দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
এমআর/ইএ

